গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-১১)


 


নিজের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় সহ একটি সাইডব্যাগ এবং একটি ব্রীফকেইস ছাড়া তেমন কোনো ভারী লাগেজ আমার সাথে ছিলোনা। শিউল বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আমার সিরিয়ালে যে ট্যাক্সিক্যাবটি এসে দাঁড়ালো তাতে ওঠার সময় ড্রাইভার একটু আশ্চর্য এবং খুশিও হলো, কারণ তেমন লাগেজও নেই যাত্রীও আমি একা। কিন্তু আমার একটু ভয় লাগছিলো, না জানি কেমন লোক।

 

‘গাড়ি ছেড়েই ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবো। ঠিকানার একটা মোটামুটি ধারণা পেয়ে কোরিয়ান শিল্পীর একটা গানের ক্যাসেট বাজিয়ে দিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে ১৮০ কিঃমিঃ বেগে গাড়ি হাকাচ্ছে আর ক্যাসেটের গানের সাথে গুনগুন করে গলা মিলাচ্ছে। ভাবসাব দেখে ক্রমশঃ ভয় বাড়তে লাগলো, কিন্তু ভুল ভাংলো একদম শেষে।কি পরিশ্রমটাই না সে করেছিলো আমার জন্যে

 

প্রথম প্রথম ভাবটা এমন দেখিয়েছিলো যে, যে ঠিকানা বলেছি সেটা তার কাছে ডালভাত। কিন্তু ঠিকানার কাছাকাছি গিয়ে যখন এদিক সেদিক করছে সঠিক জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না, আমার সন্দেহ হলো, সে চালাকি করছে কিনা। পরে পকেট থেকে ঠিকানা লেখা একটি কাগজ তার হাতে দিতে গেলে সে যেটা বোঝাতে চাইলো, তাতে কোন টেলিফোন নম্বর আছে কি না। কাগজটি হাতে নিয়েই গাড়ি পার্ক করে ছুটলো টেলিফোন বুথের দিকে।

 

কোরিয়ান ভাষার নিজস্ব কোন সংখ্যা নাই। তারা তাদের ভাষার সাথে ইংরেজি সংখ্যা ব্যবহার করে। ইংরেজিতে ঠিকানা লেখা কাগজটিতে ফোন নম্বর লেখা ছিলো যেটা অনায়াসেই সে বুঝতে পারে। বুথ থেকে সেই নম্বরে ফোন করে জায়গার মোটামুটি অবস্থান জেনে পূনরায় গাড়ি হাঁকালো। কিছুদূর যায় আর বুথে নেমে ফোন করে। ঘুরে এসে বিরক্তি প্রকাশ করে। এভাবে চার পাঁচবার নেমে ফোন করে সঠিক অবস্থান বেড় করতে না পেরে অবশেষে আমার অপরপ্রান্তের বন্ধুরা তাদের অবস্থান থেকে - কিলোমিটার দূরের এক রেলষ্টেশনের কাছে যেতে বলে। এভাবে আমার কাঙ্ক্ষিত বন্ধুদের ঠিকানায় পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এবং ক্যাব ড্রাইভারকে কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ জানালাম। বন্ধুদের বাসায় পৌঁছে তাদের নিজহাতে রান্না করা ভাত-তরকারি খেয়ে অবসান হলো দুদিনের উপবাসের দীর্ঘপথযাত্রার।

 

শিউল শহরে প্রথম পদার্পণ করেই পেলাম রাত। ট্যক্সিক্যাবে চলার সময় রং-বেরঙের আলো ঝলমল শহরের চাকচিক্য দেখে মনে হয়েছিলো, ‘আমরা কোথায় আছি’! দৈর্ঘ্য প্রস্থে আনুমানিক ৫০-৬০ কিলোমিটার শহরের(পরে অবশ্য বেড়িয়ে মনে হয়েছে পুরা দেশটাই একটা শহর) মাঝখান দিয়ে প্রবাহিতহাঙ’ নদীর(কোরিয়ান ভাষায় হাঙগাঙ) কারণে দুইভাগে বিভক্ত। কিন্তু তাতে কি? শহরের মধ্যবর্তী জায়গায় মাত্র ৫০০ মিটার দূরে দূরে ব্রীজ।  প্রত্যেক ব্রীজের মাঝখানে আপ-ডাউন দুইটি রেল লাইন এবং দুইপাশে আলাদা আলাদা ওয়ানওয়ে সড়কপথ। মনেই হয়না যে শহরের মাঝখান দিয়ে বড় একটা নদী বয়ে গেছে।

 

এই ঘটনা যেদিন লিখি সেদিন ছিলো ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের ০২ তারিখ। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখছি আমার জীবনের সব স্মরণীয় ঘটনাগুলিই অক্টোবর মাসে ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্যে ভারতে গমন,  সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি চাকরিতে যোগদান সেও অক্টোবর মাসেই। প্রথম বিমান ভ্রমণ তথা বিদেশ গমন(মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতগমন বাদে) ০৯ অক্টোবর ১৯৯২।

 

বন্ধুদের বাসায় দুদিন টানা বিশ্রাম নিলাম। তারপর কখনও কো্নো বন্ধুর সাথে, কখনও একা এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। প্রথম একটি দ্রুত উন্নয়নশীল(উন্নতপ্রায়) দেশে বেড়াতে গিয়ে সেদেশের চাকচিক্য জীবনযাত্রার মান দেখে মন পরিবর্তণ হতে লাগলো। দেশে ফিরে আসতে মন চাইছিলো না, তাই কোম্পানিতেও দেখা করতে যাচ্ছিনে। দেখা করলে যদি বাধ্যতামূলক চলে যেতে হয় সে ভয়ে। কিন্তু ভিসা মাত্র ৩০ দিনের। এরপর যদি এক্সটেনশন করাতে না পারি তাহলেওভার-ষ্টেহয়ে যাবে।

এসব ভাবতে ভাবতে প্রায় ২০/২৫ দিন চলে গেলো। এরমধ্যে আমার বন্ধুদের প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার কয়েকদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, 'তুমি কোনো কাজ করবে কিনা' কিন্তু তার কথা ফিরিয়ে দিয়েছি। পরে সে আমার একজন ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিলো। বন্ধুদের কর্মস্থলের পাশেরই আরেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সুযোগ পেলেই আমার সাথে এসে গল্পে মেতে উঠতো। সেও মাঝেমধ্যে কাজের অফার দিতো। তাকেও একই কথা বলতাম, কারণ একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম।

 

অবশেষে পাশের সেই মালিকটি একদিন এসে খুব করে বুঝালো, ‘আমার এক গার্ল ফ্রেন্ড আমাকে খুব করে ধরেছে তার প্রতিষ্ঠানের জন্য দুএকজন বিদেশি কর্মী জোগাড় করে দিতে। তার অফিস বা কারখানা যে জায়গায় অবস্থিত সেখানে বিদেশিদের আনাগোনা কম তাই। তোমার কোনো সমস্যা হবেনা। আমি তোমার ষ্টে-অর্ডার করিয়ে দেবো ইত্যাদি’। ‘বেচারার গার্ল ফ্রেন্ড অনুরোধ করেছে তাই তার আর তর সইছেনা। কিন্তু পরে দেখলাম বিবাহিত গার্ল ফ্রেন্ড’।

 

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম, থেকেই যাবো। চাকরি করতে রাজি হওয়ায় ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটি তার গার্ল ফ্রেন্ডকে খবর দিলো আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং পরেরদিনই চলে এলো নিতে।

 

‘কোরিয়ান সমাজে মেয়েরাই সংসারের প্রধান। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে কাজ করে। কিন্তু সংসারের আয়-ব্যয়ের হিসেব, বাজার বা শপিং ইত্যাদি যাবতীয় কাজকর্মের পরিচালক মেয়েরা। শুনেছি সেদেশে ২২ বছর বয়স হলে মেয়েদেরকে সাবালক ধরা হয়। বিয়েও হয় দেরীতে এবং জন্মহারও কম। শীতপ্রধান দেশ বলেই নাকি এমন। মেয়ে পূরুষ কারোরই বয়স অনুপাতে শরীর বাড়েনা। ৫০ বছর বয়সী একজনকে দেখলে মনে হবে ৩৫-৪০ বছরের যুবক বা যুবতী।

 

তেমনি এক পরিবারে পিতার অবর্তমানে সদ্য বিবাহিত এক মেয়ে হাল ধরেছে একটি নীটিং ফ্যাক্টরীর। মেয়েটির আগে যার সাথে মন দেয়া-নেয়া হয়েছিলো, কিন্তু ঘটনাক্রমে তার সাথে বিয়ে হয়নি সেই বন্ধুর কাছেই বিদেশি কর্মী সংগ্রহ করে দিতে অনুরোধ করেছিলো। তার স্বামী আবার অন্য একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করে। আমি তার কোম্পানিতে জয়েন করার কিছুদিনের মাথায় অবশ্য তার স্বামীকেও সে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে তার কোম্পানির পরিচালক হিসেবে জয়েন করায়।

 

সে যেদিন আমাকে নিতে আসবে তার বন্ধু আগে থেকেই আমাকে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন। আসার পরে খবর দিলে গিয়ে দেখলাম, কোরিয়ানসিরিমোনিয়াল ড্রেস”হাফপ্যান্টের সাথে হাফহাতার মেয়েলী কোটপরিহিত ছোট একটি মেয়ে বসে আছে। সেই নাকি মালিক!

 

কোরিয়াতে দেখেছিলাম, শীতের প্রকোপে ছেলেরা ওভারকোট পরে। অথচ মেয়েরা অন্যান্য সময় ওভারকোট পরলেও আনুষ্ঠানিক পোষাক পরার সময় হাফপ্যান্টের সাথে হাফহাতার কোট। .........(চলবে)

 

(আতাউর রহমান খান. ঢাকা ০৩/১০/২০১৪ ইং)

 

 

 

 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url