গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-৩১)



সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানালাম আগামীকাল চলে যাবো, তোমাদের ভাড়াটা আজই বুঝে নাও। নেপালী মহিলা হোটেল মালিক তার ছেলে, মেয়ে এবং কয়েকজন মেয়ে-পুরুষ কর্মচারী নিয়ে নিচতলায় খাবারের হোটেল এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আবাসিক হোটেল চালায়। রোজ সকালে ওখান থেকেই নাস্তা করে বেরোই। বিকেলেও ওই এলাকায় থাকলে কখনও কিছু খাই। সেদিনও বাইরে থেকে এসে নিচতলায় দেখা করতে গিয়ে ‘মোমো’র অর্ডার দিলাম। চলে যাবো শুনে হোটেল মালিকের মেয়ে রুস্মিতা স্পেশাল ‘মোমো’ বানিয়ে আমাদেরকে আপ্যায়িত করলো। কিন্তু সেদিনের কো্নো বিল নিলো না।

রুস্মিতা (২০১১)-দার্জিলিং

আমাদের দেখাশুনা করতো তাদেরই এক মেয়ে কর্মচারী। সামান্য লেখাপড়া জানা মেয়েটা খুবই বিনয়ী ছিলো। সকালে আমাদের চেকআউটের সময় ভাড়া নিতে এলে বললাম, ‘একটা বিল দাও’। হোটেলের এক কোনায় ছোট্ট অফিসের ডেস্ক থেকে বিলের প্যাড এবং কলম বের করে দিয়ে বললো, ‘আমি পড়ালেখা জানিনে তুমি লিখে নাও’।

 

‘জীবিকার অন্বেষণে নেপাল থেকে দার্জিলিং এসেছে। মনের কৌতূহল থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছুই লেখাপড়া জানো না’? বললো, ‘মাত্র ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি, ইংরেজি তেমন লিখতে পারিনে’। নেপালের মেয়ে ফাইভ পর্যন্ত পড়াশুনা করে কতটুকু শিখেছে সেটা জানার কৌতূহল নিয়ে বললাম, ‘তুমি যা পারো তাই লিখে দাও’।

 

লেখার সময় ওর হাত কাঁপছিলো,- এই সুযোগে আমি ওর ছবি তুলছি দেখে আড়ষ্টতা অনুভব করছিলো। ফলে আবারো আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো লিখতে। কিন্তু আমি নাছোরবান্দা, ওকে দিয়েই লিখালাম। দেখলাম ফাইভ পাশ হলেও নাইন টেনের মানে খুব সুন্দর করেই ইংরেজিতে লিখেছে বিলটা। 

দার্জিলিং-এর হোটেল কর্মচারী নেপালী মেয়েটি

দার্জিলিং শহরের মাঝখান দিয়ে যে প্রধান সড়ক গিয়েছে সেটাকে বলে গান্ধী রোড। গান্ধী রোডের মোড়ে সারি সারি শিলিগুড়িগামী জীপ গাড়ি দাঁড়ানো থাকে সকালে। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখ সকালে যে গাড়িটাতে উঠলাম, তাতে যাত্রীদের মধ্যে দু'জন বাদে সবাই অবাঙ্গালি। দুজনের একজন ছাত্র, অন্যজন চাকরিজীবী। দুজনের বাড়িই শিলিগুড়ি। তারা সহ গাড়ির সবাই নেপালী ভাষায় কথাবার্তা বলছিলো। ছাত্র ছেলেটির বাড়ি শিলিগুড়ি শহরে, পুরাপুরি বাঙ্গালি, দার্জিলিংএ একা থেকে লেখাপড়া করে। আমরা বাংলাদেশী জেনে, বাংলা বলার সুযোগ পেয়ে সে বেশ আলাপ জমালো। ছেলেটি অতিশয় ভদ্র ও মার্জিত।  

 

‘আমরা বাংলাদেশী ওরা হয়তো শতপুরুষ আগে থেকেই হিন্দুস্থানী। আমরা ১৪০০ বছর যাবৎ মুসলমান, ওর পূর্বপুরুষরা হয়তো হাজার হাজার বছর আগের সনাতন ধর্মের অনুসারী হিন্দু। আগে কোনো জানাশোনা নেই। তাতে কী’? জীপ থেকে নেমে শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ডের সন্ধান জানতে চাইলে ছেলেটি আমার ও আমার স্ত্রীর হাতের ব্যাগ দুটো ঘাড়ে নিয়ে হাটা শুরু করলো। কোনো অনুরোধেই তাকে নিবৃত করা গেলো না। আমার হাতে শুধু কম্বল ও অন্য একটি পলিথিনের ব্যাগে দার্জিলিং থেকে কেনা কাপড়চোপড়।

 

বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে কাউন্টার থেকে টিকেট নিয়ে চেংড়াবান্ধাগামী (মূলতঃ কোচবিহারগামী) বাসে উঠিয়ে দিয়ে তারপর ছেলেটি আমাদের কাছ থেকে বিদেয় নিয়েছিলো। এমন ছেলের বাবা-মা স্বর্গেও শান্তিতে থাকবে। ‘এমন ছেলের বাবা-মা স্বর্গে স্থান পাবেনা তো কি অন্য কেউ’!

 

দার্জিলিং থেকে সকালে জীপে ওঠার সময় নাস্তা খেয়ে উঠিনি। ভেবেছিলাম শিলিগুড়ি গিয়ে নাস্তা করবো। ওদিকে ডায়বেটিসের রোগী স্ত্রী হোটেল থেকে বেরোনোর আগে ইনসুলিন নিয়ে বেরিয়েছিলো তা জানলাম গাড়িতে ওঠার পরে। ইনসুলিন নেয়ার আধা ঘন্টা পরেই কিছু খেতে হয়, নইলে মাথা ঘোরা শুরু হয়ে যায়। ঘন্টাখানেক চলার পর সে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলো না। নাস্তা করার মতো ভালো জায়গাও পাওয়া যাচ্ছিলো না। অবশেষে সমতল এলেকায় এসে বিরাট আকারের এক হোটেলের কাছে ড্রাইভার জীপ থামিয়ে সবাইকে নাস্তা করার সুযোগ দিলো।

 

সেই হোটেলে সুস্বাদু ‘কচুরী’ নাস্তা পেয়ে দীর্ঘ আটদিন পর বাঙ্গালি খাদ্যের স্বাদ গ্রহন করে তৃপ্ত হলাম।

 

‘পাঠক বন্ধুদের তিন তিনবার কোলকাতা থেকে ঘুরিয়ে এনেছি, কিন্তু কোলকাতার বিখ্যাত কচুরী নাস্তার কথা বলতে ভুলে গেছি। ‘লুচির সাথে আলু-পটল-কপি দিয়ে লাবড়া ঘন্টের মতো এক প্রকার সুস্বাদু তরকারি দিয়ে সকালের নাস্তা পাওয়া যায়’। কোলকাতায় তার নাম কচুরী নাস্তা’।.........(চলবে)।

(২০১১ সালের ঘটনা। লেখা ২০১৪ সালে)

 

 

 





Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url