গৃহপরিচারিকা থেকে লেখিকা হয়ে ওঠার কাহিনী
লেখিকা বেবী হালদার
বেবী হালদার |
বিয়ের পরে
স্বামীর অত্যাচারে কার্যত বাধ্য হয়ে দিল্লীতে এসে বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ
করতেন বেবী হালদার। শেষ পর্যন্ত কাজ পেলেন মুন্সী প্রেমচন্দের নাতি অধ্যাপক প্রবোধ
কুমারের বাড়িতে। মেয়েটি মাঝেই মাঝেই তাক থেকে পেড়ে আনতো বই। কিছুক্ষণ বইয়ের পাতায়
চোখ বুলিয়ে আবার রেখে দিতেন যথাস্থানে। এই ঘটনা চোখ এড়ায়নি গৃহকর্তা প্রবোধ
কুমারের। দক্ষিন ভারত বেড়াতে যাবার সময় তিনি তাকে একটা ডায়েরি আর কলম দিয়ে
গিয়েছিলেন আর বলেছিলেন কিছু লিখতে। মেয়ে তো হতবাক! কী নিয়ে লিখবেন তিনি! সেই
মেয়ের বই "আলো আঁধারি" বেস্ট সেলার হয়েছে। অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি ভাষায়।
কাশ্মীর
উপত্যকায় ১৯৭৩ এ জন্ম এই বাঙালি কন্যার। মদ্যপ সেনাসদস্য বাবার নিত্য অত্যাচারে
তার মা তাদের দুই বোনকে নিয়ে চলে আসে মামার বাড়ি মুর্শিদাবাদে। তখন তার বয়স ছিলো
চার বছর। তার মা আবার বিয়ে করে। সৎ বাবার সংসারে বড় হতে থাকে সে। ক্লাস সিক্সে
পড়ার সময় আচমকাই শেষ হয়ে যায় তার মেয়েবেলা।
একটা বাচ্চা
মেয়ের যখন ফ্রক পরে খেলাধুলো করার কথা, তখন তাকে বসিয়ে দেওয়া হয় বিয়ের পিঁড়িতে।
শেষ হয়ে যায় তার "শৈশব”। খেলার মাঝখান থেকে তাকে উঠিয়ে এনে মণ্ডপে একটা লোকের
পাশে বসিয়ে দেয়া হয়। কিছুই বুঝতে পারছিলো না মেয়েটা। ভেবেছি্লো বোধহয় কোনো পুজো
হচ্ছে। শেষমেষ তাকে বলা হলো, ‘ওই লোকটার সাথে চলে যেতে হবে তোমাকে। তখন মেয়েটার
বয়স মাত্র ১২ বছর আর স্বামীর ২৬।
বিয়ের প্রথম
রাত থেকেই তার উপর শুরু হয় অত্যাচার। পতি দেবতাটির ধারণা, বউয়ের তো শুধু দুটোই
কাজ; সন্তান ধারণ আর রান্না করা। কুড়ি বছর বয়সের মধ্যে মেয়েটি তিন সন্তানের মা
হয়ে গেলো। তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সন্তানদের জীবন তার জীবনের মতো হলে হবে না।
১৯৯৯ সালে ২৫ বছর বয়সী তরুণী মা- তার তিন সন্তানকে নিয়ে দিল্লীগামী একটি ট্রেনে
উঠে বসে।
দিল্লীতে এসে
সে বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতে শুরু করে। একেতো অল্প বয়স, তার ওপর নেই
কোনো অভিভাবক। কাজের জায়গা থেকেই নানা কুপ্রস্তাব আসতে লাগলো। নানান বাড়ি ঘুরে
শেষ পর্যন্ত কাজ পেলো অধ্যাপক প্রবোধ কুমারের বাড়িতে। অধ্যাপক প্রবোধ কুমার ছিলেন
মুন্সী প্রেমচন্দের নাতি।
বইয়ের তাক
ঝাড়ামোছা করতে গিয়ে মেয়েটি মাঝেই মাঝেই তাক থেকে পেড়ে আনতো বই। কিছুক্ষণ বইয়ের
পাতা্য চোখ বুলিয়ে আবার রেখে দিতো যথাস্থানে। এ ঘটনা চোখ এড়ায়নি গৃহকর্তার, যাকে
সে তাতুস বলে ডাকতো। ‘তাতুস’ অর্থ বাবা। তিনিই তাকে এ নামে ডাকতে বলেছিলেন। একদিন
তিনি বেবীর হাতে তুলে দেন তসলিমা নাসরিনের লেখা “আমার মেয়েবেলা” বইটি।
“বইটা পড়ে আমার
খুব ভালো লেগেছিলো। মনে হয়েছি্লো, যেনো আমার কথাই এখানে লেখা আছে”- বলছিলো বেবী।
এর কিছুদিন পর
দক্ষিণ ভারত ভ্রমণে যাওয়ার আগে নিজের ড্রয়ার থেকে তাকে একটা ডায়েরি আর কলম দিয়ে
যান অধ্যাপক প্রবোধ কুমার। বলে যান কিছু লিখতে। মেয়ে তো হতবাক! কী লিখবেন তিনি!
ভেবেচিন্তে
লিখলেন তার হারানো শৈশবের কথা। লিখলেন তাঁর প্রথম স্বামীসহবাসের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার
কথা। লিখলেন তেরো বছর বয়সে প্রসব যন্ত্রণার গা শিউরে ওঠা কথা। লিখলেন বছরের পর বছর
ধরে নির্যাতনের ফলে শরীরে ফুটে ওঠা ক্ষতের কথা। লিখতে লিখতে ফিরে এলো বোনের স্বামী
কর্তৃক বোনেকে গলা টিপে ধরার অবদমিত স্মৃতি। তাও লিপিবদ্ধ করলেন লেখায়।
প্রায় কুড়ি বছর
পর লিখছিলেন। প্রথম দিকে বানান, বাক্য গঠন নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছিলো। পরে একটু
একটু করে পুরনো অভ্যাস মনে পড়্তে তার। লেখায় পরিপক্কতা আসে। লিখতে থাকলেন তিনি।
পরে বলেছেন, “যতো লিখতাম, ততোই ভালো লাগ্তো। মনে হতো যে্নো অনেক দিনের কোনো ভার
আমার বুকের ওপর থেকে সরে যাচ্ছে।”
প্রবোধ কুমার
ফিরে এসে দেখলেন, একশো পৃষ্ঠার বেশি লেখা হয়ে গেছে। এটাই বেবী_হালদারের প্রথম বই -
"আলো আঁধারি।" প্রথমবার পড়ে কেঁদে ফেলেছিলেন অধ্যাপক প্রবোধ কুমার। যে
সমস্ত সাহিত্য-অনুরাগীদের লেখাটি দেখিয়েছিলেন তিনি, তাঁরা অনেকে ‘অ্যান ফ্রাঙ্কের
ডায়েরির’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন লেখাটির।
বহু প্রকাশক
নাকচ করে দেওয়ার পর শেষ অবধি কলকাতার একটা ছোট প্রকাশনী – ‘রোশনি পাবলিশার্স’ –
বইটি ছাপতে রাজি হয়।
“একদিন একটা বই
দেখিয়ে তাতুস আমাকে বললেন, ‘এটা তোমার বই। তুমি লিখেছো এটা’। আমার লেখা ছাপা বই
আমার সামনে হাজির! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না!”
ঝাড়ুদার,
গৃহপরিচারিকা, পাশের বাড়ির অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা, আধুনিক কলেজ পড়ুয়া
মেয়েরা, সবাইকে নাড়া দিয়েছিলো বেবীর কাহিনী।
বইটির ইংরেজি
অনুবাদ করেছেন ঊর্বশী বুটালিয়া। ২০০৬ সালে বইটি বেস্ট সেলার তালিকায় ছিলো। একুশটি
আঞ্চলিক এবং তে্রোটি বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে বইটি!
আরো দুটি বই
লিখেছেন বেবী। লেখা তাকে দিয়েছে আত্মপরিচয়, যা আগে ছিলোই না।
অর্থনৈতিক ভাবে
নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় পৌঁছে বেবী তাঁর তিন সন্তান;- সুবোধ, তাপস ও
পিয়া’কে নিয়ে কলকাতায় বসবাস আরম্ভ করেন।
“এখন আমি
বিশ্বাস করি, মানুষ সব পারে। আগে আমি পরিচারিকা ছিলাম। এখন আমি লেখিকা। আমি সবাইকে
এটাই বলি, শুরুটা যে কোনো সময়ই করা যায়।”
লেখাঃ স্বপন
সেন
সম্পাদনাঃ
আতাউর রহমান খান
কৃতজ্ঞতাঃ
@কাশফুল