গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-২৮)

 



পরেরদিন সকাল দশটা সাড়ে দশটার দিকে পূর্বে বর্ণিত সেই হোটেল পরিচারক হঠাৎ রুমের দরজায় জোরে করাঘাত করে আতংকিত কণ্ঠে ডাকাডাকি করছে। তড়িঘড়ি দরজা খুলতেই বললো, ‘হিমালয় দেখতে চাইলে তাড়াতাড়ি বেরোন বেরিয়ে হীরক উজ্জ্বল হিমালয়ের চূড়া দেখতে পেয়ে মনটা শান্তিতে ভরে গেলো। তাড়াতাড়ি কাছে থাকা ডিজিটাল ক্যামেরায় কয়েকটি ছবি তুলে রাখলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘের আড়ালে চলে গেলো হিমালয়। সকালে আকাশ একটু পরিস্কার হলেও একটু পরপর মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছিলো। হোটেলের সাহায্যকারীর তাড়াহুড়ো করে ডাকার কারণ ছিলো সেটাই।

 

বেড়ানোর কোনো শেষ নেই। গল্পের শুরুতেই বলেছিলাম এমন অনেকেই আছেন যিনি তার পাশের গ্রামেই যাননি অথচ সারা বিশ্ব ভ্রমণ করে ফেলেছেন। অতএব, হিমালয় দেখা হলো, তাই সময় স্বল্পতার কারণে ভাবলাম, এখানে আর দেরী না করে দার্জিলিং বেড়িয়ে তারপর দেশে যাবো।

 

হোটেল মালিকের কাছে বাস টিকেট কোথায় পাওয়া যাবে জানতে চাইলে আমাদের পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত পরিচারকের নাম উল্লেখ করে বললো, 'ওকে টাকা দেন, ওই আপনার টিকেটের ব্যবস্থা করে দেবে' পরে নির্দিষ্ট সময়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে দেখা গেলো, টিকেটের প্রকৃত মূল্যের অধিক টাকা নিয়েছে পরিচারক। তাই কাজটি ভুলেও কেউ করবেন না। আজকাল গুগলে ক্লিক করলে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই পাওয়া যায়। নেপালের প্রধান প্রধান রুটের ভালো ভালো বাস কোম্পানির ওয়েব সাইটে টিকেটের মূল্য, বাসের লোকেশন, ছাড়ার সময় ইত্যাদি সব ধরণের তথ্য পাবেন।

 

বেলা পৌনে পাঁচটায় বাস ছাড়বে। সময়ের আগেই বাস স্ট্যান্ডে এসে দেখলাম সাধারণ মানের একটি বাস। তবে স্ট্যান্ডের লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো, এ ধরণের বাসই পোখরা থেকে কাকরভিটা ছেড়ে যায়। এর চেয়ে ভালো বাস নেই।

 

ওটাই ছিলো সেদিনের শেষ বাস। অন্যান্য দেশের দুএকজন পর্যটককেও দেখলাম। বাস ছাড়ার পনর বিশ মিনিট আগে বিরাটাকারের হিল ট্রেকিং এর এক ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা কোরিয়ান মেয়ে এসে আমাদের পাশের সিটে ব্যাগটা রেখে আমাদেরকে একটু লক্ষ্য রাখতে বলে নিচে নামলো। অল্প বয়সী মেয়ে, দেখতেও খুব সুন্দরী এবং চেহারায় শিক্ষিতের ছাপ। কিন্তু দেখতে পেলাম, নিচে নেমে সে একটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে পূরোদস্তুর নেশাখোরের মতো টানছে আর কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। দেখে হাঁসিও পেলো, আবার অমন গাঁজাখোড়ের মতো ধুমপান করতে দেখে মনে মনে একটু রাগও হলো।


২০১১ সালে পোখরা থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে দেখা সেই কোরিয়ান মেয়েটি

কোরিয়ানরা এমনিতেই বয়োজ্যেষ্ঠদের খুব সম্মান করে। ওদের দেশে বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান জানানোর জন্যেবিশ্ব প্রবীন দিবসখুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করা হয়। প্রবীনদেরকে বিভিন্ন উপহার, উপঢৌকন দিয়ে সম্মান জানানো হয়।

 

আমিও কোরিয়াতে কিছুদিন ছিলাম, তাই মেয়েটি কোরিয়ান জেনে স্বাভাবিক কারণেই তার সাথে আলাপ করার একটা আগ্রহ তৈরি হলো। বাসে তার সাথে আলাপ করে জানলাম, তার বাবা একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের মালিক। নিজেকে ছাত্র পরিচয় দেয়ায় এবং তার কাছে ভ্রমণ সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র জায়গার মানচিত্র দেখে ভেবেছিলাম হয়তো পর্যটন শিল্পের উপরে পড়াশুনা করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে অথবা কোথায়ও ইন্টার্নই করতে বিদেশে এসেছে। কিন্তু আলাপের এক পর্যায়ে জানা গেলো, সদ্য স্থাপত্যবিদ্যায় পড়ালেখা শেষ করে কোনো কাজে নিয়োজিত হওয়ার আগে শুধু ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই বিদেশে এসেছে।

 

মেয়েটির সাথে কথা বলে তার প্রতি একপ্রকার মমতা তৈরি হয়ে গেলো। কিন্তু অমন গাঁজাখোরের মতো ধুমপান করার কথা ভুলতে পারছিলাম না। বিষয়টি নিবারণ করার চেষ্টা হিসেবে স্নেহের অধিকার নিয়েই এক পর্যায়ে বলে বসলাম, সাধারণতঃ অতিরিক্ত যৌনাকাংক্ষী মেয়েরা ধুমপানে আশক্ত হয়। তোমাদের দেশের মেয়েরাতো সে প্রকৃতির না। তাছাড়া তুমি একজন উঠতি বয়সী শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এভাবে ধুমপান করো কেনো। কাকরভিটা পর্যন্ত সারা রাস্তায় তাকে আর ধুমপান করতে দেখা যায়নি।

 

পোখরা থেকে কাকরভিটার দূরত্ব ৬৩৮ কিলোমিটার। যাত্রার সময়কাল ১২-১৪ ঘন্টা। সেটাও সুযোগ সন্ধানী বাস কর্মচারীদের কারণে বেড়ে গিয়ে কাকরভিটা পৌঁছতে সময় লাগে ১৭-১৮ ঘন্টা। আগেরদিন বিকেল পৌনে পাঁচটায় বাস ছেড়ে পরেরদিন সকাল সাড়ে দশটায় বাসটি গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়। এতো দীর্ঘ বাস জার্নি কখনও করিনি। তবে এতো রাস্তা পারি দিয়েও শরীরে তেমন ক্লান্তি অনুভব করিনি। শুধু খারাপ লেগেছিলো যখন দূরপাল্লার বাস হয়েও মাঝপথে একটি বড় স্ট্যান্ডে দেড় দুই ঘন্টা সময় লাগিয়ে টমেটোর বস্তা দিয়ে বাসের ছাদ বোঝাই করছিলো তখন। আগেই বলেছি, টমেটোগুলি পশ্চিম বাংলায় চালান হয়।

 

বাস থেকে নামার পরে কোরিয়ান মেয়েটি কোথায় হারিয়ে গেলো আর খোঁজ রাখতে পারিনি। কাকরভিটায় বর্ডারের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নেপালকে বিদায় জানিয়ে রিকশায় মেছি ব্রীজ পার হয়ে পশ্চিম বাংলার রাণীগঞ্জ (পানিট্যাংকি) এলাম। রাণীগঞ্জ ইমিগ্রেশন অফিসে বর্ডার আনুষ্ঠানিকতা শেষে নাস্তা করে যখন গাড়িতে উঠতে গেছি, দেখি সেই গাড়িতেই ওই কোরিয়ান মেয়েটি বসা। বাসে আলাপের সময় শুনিনি যে সেও শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং যাবে। একই গাড়িতে উঠতে দেখে এবং আমরাও দার্জিলিং যাবো জেনে একটু খুশিই হলো।  কারণ কাকরভিটা থেকে গুন্ডা টাইপের একটা নেপালী ছেলে ওর পিছু নিয়েছিলো এবং নানাভাবে অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করছিলো। গাড়িতে উঠে মেয়েটির হাবভাবে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ছেলেটার মন অন্যদিকে পরিবর্তণ করার কৌশল হিসেবে ছেলেটির সাথে দীর্ঘ আলাপ শুরু করে দিলাম।

 

কালো সুঠাম দেহের অধিকারী ‘বীরেন্দ্র থাপা’ নাম্মী মোটামুটি ধনীর দুলাল ছেলেটি বাংলাদেশে ঢাকার উত্তরাস্থ ‘ইস্ট ওয়েষ্ট’ মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করে। বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে বাংলাদেশে আসছে। ভাবলাম শিলিগুড়ি পর্যন্ত গেলে ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে। কারণ শিলিগুড়ি থেকে পরিবর্তণ করে দার্জিলিং এবং বাংলাদেশ যেতে আলাদা আলাদা গাড়িতে উঠতে হবে। কিন্তু নাছোরবান্দা ‘বীরেন্দ্র’ শিলিগুড়ি গিয়ে মত পাল্টে ফেললো। সেও দার্জিলিং যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

 

আমরা মেয়েটির পিতৃ-মাতৃ সম দম্পতি একসাথে। সে কারণে সে আমাদের সান্নিধ্য বা আনুকুল্য পাওয়ার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু পূনরায় একই গাড়িতে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার সময় পথিমধ্যে এক স্টলে নাস্তা করতে নামলে নেপালী ছেলেটি ‘দার্জিলিং-এর সব দর্শনীয় স্থান আমার নখদর্পণে, আমরা একই হোটেলে এমনকি তুমি চাইলে একই রুমে উঠতে পারি’ ইত্যাদি বলে মেয়েটিকে অতিষ্ঠ করে তুলছিলো। মেয়েটিও খুব ধৈর্যের সাথে সবকিছু সামাল দিচ্ছিলো এবং অত্যান্ত চতুরতার সাথে ছেলেটির কথার জবাব দিচ্ছিলো, যেনো সে এটাই বোঝে যে, ‘আমি তোমার কথায় রাজি আছি’। মেয়েটির হাবভাবে আমিও একটু বিভ্রান্তিতে পড়েছিলাম যে, আসলেই কি সে ছেলেটির সাথে ঘনিষ্ঠতায় জড়াতে যাচ্ছে? কিন্তু মেয়েটির আচরণ পাল্টে গেলো দার্জিলিং পৌঁছে।

 

শিলিগুড়ি থেকে প্রায় অর্ধেক রাস্তা সমতল এবং বাকি অর্ধেক রাস্তা পাহাড় বেয়ে ৮০ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে দার্জিলিং পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমে আগে হোটেলে ওঠার চিন্তা। কোরিয়ান মেয়েটি নেপালী ছেলের সাথে আন্তরিক হয়ে গেছে, ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কি দরকার’ এ ধরণের চিন্তা করে যে যার মতো পথ ধরেছি। এমন সময় দেখি মেয়েটি যতোই ছেলেটিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, ছেলেটি ততোই তার ব্যাগ ধরে টানাটানি করছে একসাথে যাওয়ার জন্যে। দৃশ্যটা দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মেয়েটিও আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। বিষয়টা বুঝতে পেরে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তুমি কোনো চিন্তা করোনা, আমি দেখছি।

 

আমরা যে হোটেলে উঠি সে হোটেলে উঠতে পরামর্শ দেয়াও নিরাপদ মনে হচ্ছিলোনা, ছেলেটি সেখানেও ঝামেলা করতে পারে ভেবে। ‘তুমি যেদিকে যাবে যাও’ মেয়েটিকে বলে ছেলেটির দিকে এগিয়ে গিয়ে তার সাথে কথা বলার বাহানায় ‘এনগেজ’ করতে চেষ্টা করলাম। ছেলেটিও আমাদের হস্তক্ষেপ দেখে একটু আড়ষ্টতা অনুভব করছিলো। বুঝতে পেরে তাকে একটু শাসনের সুরে বললাম, ‘একা বিদেশী একটা মেয়ে, ওকে ‘ডিস্টার্ব’ করছো কেনো? ও যেদিকে যেতে চায় যেতে দাও। তুমি বরং আমাদের সাথে একই হোটেলে উঠতে পারো’। পরে অবশ্য ইচ্ছে করেই ওই ছেলের সাথে এক হোটেলে উঠিনি। তবে মান ভাঙ্গনোর জন্যে ওর মোবাইল সেটের ব্যাটারী ছিলো না জেনে নোকিয়া সেটের পুরনো একটা ব্যাটারী উপহার দিয়েছিলাম।

 

চালাকি করে ছেলেটিকে অনুরোধ করেছিলাম, ‘তুমিতো সব চেনো, তোমার সাথে দার্জিলিং-এর দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে ঘুরে দেখবো’। জবাবে ছেলেটি বললো, ‘দারজিলিং-এ আমার কোনোকিছু দেখতে বাকি নেই। আমি সকালেই ঢাকা চলে যাবো’। মনে মনে বললাম, ‘মিঠাইমে কুছ নেমক থা’। …….........(চলবে)

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url