গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-২৫)
‘আমাদের যাত্রার সময় নির্দিষ্ট
ছিলো আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে। আগেই বলেছি ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এক সপ্তাহ
পিছিয়ে ঢাকা থেকে রওনা দিতে হয় সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে। ওই সময় আমাদের দেশে পূরোমাত্রায়
গরম আবহাওয়া। নেপালের আবহাওয়া ঠান্ডা হতে পারে অনেকের কাছে শুনলেও আমাদের দেশের শীতকালের
মতো ঠান্ডা হবে এমনটি ভাবিনি। তাই শীতের কাপড় দূরের কথা হাফ শার্ট পরে গিয়েছি'।
'সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪০০
মিটার (৪৬০০ ফুট) উপরে নেপালের রাজধানী কাঠমুণ্ডতে শীত তেমন না হলেও হিমালয়ের পাদদেশে
অবস্থিত পোখরা শহরে হোটেল রুমে রীতিমতো ডবল কম্বল গায়ে দিয়ে শীত নিবারণ করতে হয়েছে।
গোসল ও অন্যান্য কাজে গরম পানি ব্যবহার করতে হয়েছে। ওইসব শহরের সব আবাসিক হোটেলেই ঠান্ডা,
গরম সব ধরণের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা আছে'।
'পোখরা হিমালয়ের পাদদেশে
হলেও শহরটা সমতল ভুমি। সেখান থেকে পাহাড় শুরু এবং অনেক দূর পর্যন্ত উঁচু পাহাড়ে লোক
বসতি আছে। রাতে জনবসতিপূর্ণ পাহাড়ের আলোর দিকে তাকালে মনেহয় আলাদা একটা জগৎ। সে সব
পাহাড় ডিঙ্গিয়ে পোখরা থেকে মূল হিমালয়ের দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার। তবে সোজাসুজি দূরত্ব
৪০ কি্লোমিটার। কারণ পাহাড়ী রাস্তা ঘুরে ঘুরে উঠতে হয় বিধায় দূরত্ব বেড়ে যায়’।
‘শীতে বেশি কষ্ট করতে হয়েছিলো
দার্জিলিং এসে। সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১০০ মিটার (৭০০০ ফুট) উপরে দার্জিলিং শহর। তার ৬৪
কিলোমিটার দূরেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৫৮০ মিটার (২৮,১৫০ ফুট) উচ্চতার দ্বিতীয় এভারেষ্ট
কাঞ্চনজঙ্ঘা (হিমালয়ের উচ্চতা ৮৮৪৮ মিটার বা ২৯০০০ ফুট)। ফলে সেপ্টেম্বর মাসেই সেখানে
মাঘ মাসের মতো শীত। রাতে দার্জিলিং-এর এক হোটেলে খাবার খেতে ঢুকেছি। পরিধানে হাফ শার্ট
দেখে হোটেলের এক লোক ঠাট্টা করে বলেই বসলো, ‘আপকো গরম লাগ রাহাহেইন’? শুনে একটু লজ্জাই
পেলাম'।
'দার্জিলিং এর টাইগার হিলের
উচ্চতা দার্জিলিং থেকে আরো বেশি, ২৬০০ মিটার অর্থাৎ ৮৫০০ ফুট। টাইগার হিলে সবাই সূর্যোদয়
দেখতে যায়। সেখানে শীত বেশি হবে ভেবে এবং যেতে হবে ভোরে, তাই দু’টো লেডিস শাল কিনে
দু’জন গায়ে পেঁচিয়ে গিয়েছিলাম’।
বাসে চলতে চলতে এক সময় শীতের
আমেজ অনুভব করলাম। ভোরের আলোতে নেপালের প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। উপরে
পাহাড়ের দিকে তাকালে ঘন কুয়াশায় দূরের কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। পাহাড় বেয়ে গাড়ি শুধু
উপরে উঠছে তো উঠছেই। মনে হচ্ছে এই বুঝি কাঠমুণ্ড পেয়ে গেলাম’।
‘বাস পাহাড়ের গা ঘেঁষে উপরে
ওঠার সময় রাস্তার পাশে আনুমানিক তিন’শ থেকে পাঁচ’শ ফুট নিচে ভূমির দিকে তাকালে মাথা
ঘুরে যায়। সকাল্ ৭ টার দিকে এমন এক রাস্তায় জ্যাম লেগেছে। সেখান থেকে কাঠমুণ্ড শহর
আরো ৩০ মিনিটের রাস্তা। জ্যামের কারণে গাড়িগুলো এতো সাবধানে পার হচ্ছিলো যে, একটু উনিশ-বিশ
হলেই ৫০০ ফুট নিচের জঙ্গলে’।
‘অবশেষে ঢাকা থেকে টানা
একদিন দুই-রাত জার্নি শেষে ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১, সকাল সাড়ে সাতটায় কাঠমুণ্ড শহরে গিয়ে
পৌঁছলাম। কাকরভিটা থেকে কাঠমুণ্ড বাস জার্নিতে ১৫ ঘন্টা সময় লেগেছিলো’।
‘কাঠমুণ্ড শহরের মাঝখানে
দাঁড়িয়ে দূরে না তাকালে বোঝা যায়না যে পাহাড়ের উপরে আছি। কারণ শহরের প্রধান এলাকা কিছুটা
সমতল’।
বাস থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি
নিলাম টুরিষ্ট এলাকার হোটেলে পৌঁছে দেয়ার জন্যে। কাঠমুণ্ড শহরে টুরিষ্টদের অবস্থানের
প্রধান এলাকা অর্থাৎ যে এলাকায় ভালো ভালো আবাসিক হোটেল আছে সে এলাকার নাম থামেল বা
ধামেল।
কাঠমুণ্ড ও নেপালের দ্বিতীয়
বৃহত্তম শহর পোখরায় আবাসিক হোটেলের ব্যবস্থাপনা খুব ভালো লেগেছে। ভাড়াও তুলনামূলক কম।
২০১১ সালে কাঠমুণ্ডর থামেলে নিম্ন ভাড়ার হোটেলে ডবল রুমের ভাড়া ছিলো ৮০০ টাকা। পোখরাতে
তার চেয়েও ভালো হোটেলে উঠেছিলাম মাত্র ৫০০ টাকা ভাড়ায়। তবে টুরিষ্টদের চাপ বাড়লে
ভাড়া একটু বেড়ে যায়। আমরা গিয়েছিলাম ‘ডাল সিজনে’।
‘নেপালীদের আলাদা মূদ্রা থাকলেও সে দেশে সমান্তরালভাবে
ভারতীয় মূদ্রাও চালু আছে। দেখেশুনে মনে হয়েছে, নিজের দেশের মূদ্রার চেয়ে ভারতীয় মূদ্রার
প্রতিই তাদের আকর্ষণ বেশি’।
‘নেপালে প্রবেশ করার সময়
কাকরভিটা বর্ডার থেকেই জেনেছিলাম, নেপালে ইন্ডিয়ান মূদ্রাকে বলে আইসি (ইন্ডিয়ান কারেন্সী),
নেপালী মূদ্রাকে বলে এনসি (নেপালীজ কারেন্সী) এবং আমেরিকান ডলারকে বলে ইউসি (ইউএস কারেন্সী)।
বাজারে কিছু কিনতে গেলে দোকানী আগে জিজ্ঞেস করবে, ‘আইসি’ না ‘এনসি’। তারপর মূদ্রা অনুসারে
জিনিষের দাম বলবে’।
‘আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছি;
আমাদের দেশে যেমন পিঁপড়ের সারির মতো প্রাইভেট কার দেখা যায়, নেপালে সেটা কল্পনাও করা
যায় না। রাস্তায় চলার সময় প্রতি ১০ কিলোমিটারের মধ্যে একটা প্রাইভেট কার নজরে পরেছে
কি না সন্দেহ আছে। সবাই বাসে যাতায়াত করে। একটু বিলাসী বা আরামদায়ক যাতায়াতের জন্যে
বড় আকারের ভাড়ার জীপ গাড়ি বা মাইক্রোবাসে শেয়ারে কিংবা রিজার্ভ করে যাতায়াত করা যায়’।
‘কাঠমুণ্ডতে হোটেলে অবস্থানকালিন
দেখলাম, কোলকাতা থেকে বিপুল সংখ্যক পর্য্টক কাঠমুণ্ড বেড়াতে যায়। একদল পর্য্টককে তাদের
নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের সময় বুঝতে পারলাম তারা দলবেঁধে ক্যাসিনোতে যাচ্ছে বিনোদনের
জন্যে। বাংলায় কথা বলা শুনে যেচে আলাপ করে জানতে পারলাম, তারা কোলকাতা থেকে গিয়েছে’।
‘কাঠমুণ্ডতে দেখলাম অনেকেই
বাংলা জানে। অবশ্য নেপালী ভাষার অনেক শব্দের সাথেই বাংলা ভাষার অনেক শব্দের মিল আছে।
যেমন; ওরা আদাকে বলে আদরক। বাংলা ভাষাতেও ‘আদরক’ শব্দের ব্যবহার প্রচলিত ছিলো। এখন
কমে গেছে। তাই বাংলা ভাষা বুঝতে বা শিখতে ওদের কাছে সহজ। হোটেলের পাশে এক দোকানে ওষুধ
কিনতে গেলাম। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি জেনে দোকনী তৎক্ষণাৎ হিন্দী ছেড়ে বাংলায় কথা বলতে
শুরু করলো। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, সে কোলকাতায় চাকরি করতো। বছর দু’য়েক হয় দেশে
এসে ওষুধের দোকান করেছে’।
‘এমন অনেক নেপালীই ভারতের
বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে দিল্লী, মুম্বাই, কোলকাতায় চাকরি-বাকরি করছে’। কোলকাতায় বেড়ানোর
সময় দু’জন হোটেল পরিচারক পেয়েছিলাম, যাদের বাড়ি নেপাল। নেপালীরা ভারতীয় সরকারি চাকরিতেও
সুযোগ পায়। কাকরভিটা থেকে কাঠমুণ্ড যাওয়ার সময় এমন একজনের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। সে ভারতীয়
সেনাবাহিনীতে চাকরি করে। ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে’।
দুপুর পর্য্ন্ত ঘুমিয়ে বিকেলে
শহর দেখতে বেরোলাম। কাঠমুণ্ড শহরের প্রাণকেন্দ্রে একই স্থানে অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির।
সেখানে লোকজনের ভিড় দেখে মনে হলো ওটাই শহরের বা শহরের বাইরে থেকে আগতদের অবকাশ যাপনের
প্রধান কেন্দ্র।
‘দূর থেকে নেপালের রাজ প্রাসাদ
দেখলাম। শুধু প্রাসাদ আছে রাজা নেই। নেপালের জনগন ততোদিনে রাজতন্ত্র উৎখাত করে প্রজাতন্ত্রিক
শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। রাজবংশের শেষ শাসক রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেব
তখন বনবাসে। রয়েল প্যালেস খ্যাত রাজপ্রাসাদের চতুর্দিকে সেনাবাহিনী পাহাড়া দিচ্ছে।
……………….........(চলবে)