গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-৯)









'আকাশে শান্তির নীড়' নীতিবাক্য(motto) ধারণকারী, শান্তির প্রতীক বলাকা মনোগ্রামে শোভামন্ডিত বাংলাদেশ বিমানের সার্ভিস ততো ভাল না অথচ ভাড়া বেশি সে কারণে ঢাকা থেকে ‘ড্রাগন এয়ার’ এর টিকেট কেটেছিলাম ঢাকা-শিউল-ঢাকা ৩৮,০০০/- টাকায়। ড্রাগন এয়ারের ১৭৫ আসনের ছোট্ট বিমান হংকং পর্যন্ত নিয়ে নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে ব্যাঙ্কক থেকে ছেড়ে আসা ‘ক্যাথে প্যাসিফিক’ বিমানে আমাকে শিউল যেতে হবে। প্রথম যখন বিমানে পা রাখি মনে শিহরন জাগলেও একটু নার্ভাস লাগছিলো। শুনেছি বিমানে মাথা ঘোরে, বমি আসে, এসব কথা মনে করে আগেই মাথা ঘোরা শুরু হয়ে গেলো। বিমান রানওয়েতে রান করে একটা ঝাঁকি দিয়ে যখন আকাশে উড়লো তখন সত্যি মাথা ঘুরছিলো। তবে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত উপরে উঠে সমান্তরাল চলার সময় আস্তে আস্তে তা স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং তখন মনে হচ্ছিলো যেনো একটা বাসের মধ্যে বসে আছি।

ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ভোর ৩টা ৫৫মিনিটে বিমান ছাড়ার পর বিমানবালারা আসে ব্রেকফাস্ট দিতে। ধূমপায়ী যাত্রী হওয়ায় আমার সিট পড়ে পিছনের দিকে। তারও পিছনে আমাদের একদম কাছেই বিমানের কিচেন ও স্মোকিং এরিয়া এবং টয়লেট। কিচেন থেকে কি যেন একটা উৎকট গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছিলো। বিমানবালা এসে মেন্যু দেখিয়ে যখন জিজ্ঞ্যেস করছিলো কি খাবো, আমি স্বাভাবিকভাবেই বাঙ্গালি খাবার ‘ডিম পরোটা’র অর্ডার দিয়ে দিলাম। কিন্তু ডিম পরোটা যখন এনে দিলো কিচেনের গন্ধ আর ডিমের গন্ধ একই রকম লাগছিল।

শুনেছিলাম চাইনিজরা কচ্ছপের ডিম খায়। বিমানেও তা সরবরাহ করতে পারে এটা ভেবে বিমানবালাকে ডেকে জিজ্ঞ্যেস করলে ’মুখে সুপার গ্লু’। কথা বলছেনা দেখে সচক্ষে দেখতে উঠে গেলাম কিচেনের দিকে। গিয়ে বললাম দেখাও কিসের ডিম, কিন্তু দেখাতে অপারগ। সেখান থেকেই শুরু হলো খাওয়ার উপর অরুচি। হংকং-এ ৩-৪ ঘন্টা ট্র্যানজিটকালিনও না খেয়েই কাটিয়ে দিলাম। কোনোকিছুই রুচি হচ্ছেনা। কেমন যেন একটা গন্ধ নাকে ঘোরাঘুরি করছে।

আরো বিরিম্বনার শিকার হলাম হংকং থেকে স্থানীয় সময় বেলা ১টায় ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইনসের ৬৭৫ আসন বিশিষ্ট বিরাটাকার বিমানে শিউলের উদ্দেশ্যে যখন যাত্রা শুরু হলো তখন। লাঞ্চ এনে দিলে প্লেটের পাশে এক টুকরো মাংশ দেখে সন্দেহ হলো। ‘এটা কিসের মাংশ? বিমান বালাকে ডেকে জিগ্যেস করলে ‘লা-জবাব, মুখে সুপার গ্লু’।

পাশের সিটে বসা ছিলো এক কোরিয়ান ভদ্রলোক। ’কোরিয়ান এবং চাইনিজদের একটা সমস্যা ছিলো, কেউ ইংরেজিতে কিছু জিগ্যেস করলে জবাব দেয়ার ভয়ে পাথর হয়ে যেতো। এখন তা অনেকটা কমেছে। এখন কোরিয়ান ও চীনারা ইংরেজি ভাষা শিখছে। আমি কোরিয়াতে গিয়ে তাদের ইংরেজিতে অনগ্রসরতার কথা জিগ্যেস করে জেনেছি, তাদের ইংরেজি পাঠ শুরুই হতো সপ্তম শ্রেণী থেকে’।

বিমানবালাকে অনেক পীড়াপীড়ির পরও যখন কিছু বলছেনা তখন পাশের সিটের কোরিয়ান ভদ্রলোক আমার অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে অগত্যা মুখ খুললো, ‘আর উ মুসলিম’? আমি,- ‘ইয়াহ, আই’ম মুসলিম’। বললো; ‘উ ডোন্ট ইট দিস, দিস ইজ পিগ’।

আমিতো থ। কে কি ধর্মের, কে কি খায় না খায় জিগ্যেস না করেই ঢালাও ভাবে সবাইকে শুয়োরের মাংশ পরিবেশন করলো, এ কেমন যাত্রীসেবা! পরে জেনেছি, ওই বিমানের বেশিরভাগ যাত্রীই চীন, হংকং(হংকং তখনো চীনের কাছে হস্তান্তর হয়নি), থাইল্যান্ড এবং তাইওয়ানের। চীনারা বিভিন্ন প্রদেশ থেকে হংকং বা হংকং হয়ে রাজধানী বেইজিং-এ যাতায়াত করে। মুসলিম কিংবা বাংলাদেশী কোনো যাত্রী নজরে পরেনি।

অবশেষে কোরিয়ান ভদ্রলোকের অনুরোধে বিমানবালা কোথ্থেকে যেন এক পিস পাউরুটি এনে দিল। অরুচি সত্বেও অগত্যা মুখে গুঁজে কো্নোমতে জীবন বাচালাম। ......(চলবে)।

(২০১৪ সালের লেখা)







Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url