গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-২৩)
নেপাল ভ্রমণের জন্যে
বাংলাদেশিদের কোনো ভিসা ফি লাগে না। তবে বছরে একাধিকবার গেলে দ্বিতীয়বার থেকে
লাগে। ছেলেকে পাঠিয়ে একদিনেই নেপালের ভিসা সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু ভারতের ভিসা
পেতে বেগ পেতে হয়েছিলো। প্রতিদিন গড়ে আনুমানিক এক দেড় হাজার লোক বাংলাদেশ থেকে
ভারত সফরে যায়। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে পার্শ্ববর্তী দেশে এতো লোক ভ্রমণ করতে যায়
কিনা সন্দেহ আছে।
আগের নিয়মানুযায়ী
দূতাবাস থেকে ভিসা আবেদন ফরম সংগ্রহ করে বা দূতাবাসের ওয়েব সাইট থেকে ডাউনলোড করে
যথাযথভাবে পূরণ করে লাইনে দাঁড়াতে হতো। ভিসা সহায়তাকারীদের দিয়েও সে কাজটি সম্পাদন
করা যেতো। পর্যটক বা ভ্রমণ উৎসাহীদের চাপে ২০১০ থেকে নিয়ম পাল্টে যায়। অনলাইনে
আবেদন করে সাক্ষাৎকারের তারিখের জন্যে অপেক্ষা করতে হয় এবং সপ্তাহকাল পরে
সাক্ষাৎকারের তারিখ পড়ে। সাক্ষাৎকারের দিন আবেদনপত্রের প্রিন্ট কপি, পাসপোর্টের
ফটোকপি ও আবশ্যকীয় কাগজপত্র সাথে নিতে হয়। সাক্ষাৎকার সন্তোষজনক হলে বাংলাদেশী
টাকায় ৪০০ টাকা ভিসা ফি দিতে হয় এবং পরবর্তী সপ্তাহে ভিসা সংগ্রহের তারিখ পড়ে।
ভিসা প্রত্যাশী অত্যাধিক হওয়ায় প্রত্যুষে এসে লাইনে দাঁড়াতে হয়। মহিলাদের জন্যে
আলাদা লাইন এবং তারা অগ্রগন্যতা পায়। এক্ষেত্রে একটু বুদ্ধি খাটালে সুবিধা আদায়
করা যায়। মহিলার সাথে তার স্বামী বা ছেলেমেয়ে থাকলে পাসপোর্টটি তার হাতে দিলে সে
ভেতরে যাওয়ার সময় তার সাহায্যকারী বা সংগী হিসেবে গিয়ে একসাথে কাজটি সেরে নিতে
পারে, যেটি আমি করেছিলাম।
অনেক লোককে দেখেছি ভোর
থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। তবে নিজের ভিসার জন্যে নয়। যারা পরে আসে বা আগে সুযোগ
পেতে আগ্রহী তাদের কাছে ১০০ বা ২০০ টাকায় তার সিরিয়ালটি বিক্রী করে দেয়।
‘বাংলাদেশের যে কোন
জায়গা থেকে লালমনিরহাট জেলার বুড়িমারী এবং বুড়িমারী সংলগ্ন ভারতের চেংড়াবান্ধা
বর্ডার পার হয়ে পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থেকে ভারতের রাণীগঞ্জ বর্ডার হয়ে
নেপালের কাকড়ভিটা। ‘বর্ডার রাণীগঞ্জ হলেও জায়গাটি পানিটাংকি নামেই অধিক পরিচিত’।
সেখান থেকে বাসে নেপালের রাজধানী কাঠমুণ্ড বা হিমালয় শহর পোখরা যেতে হয়। চেংড়াবান্ধা
থেকে শিলিগুড়ি ৮০ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি থেকে রাণীগঞ্জ বা কাকরভিটা ৬০ কিলোমিটার।
কাকরভিটা থেকে কাঠমুণ্ডর দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার’।
ঢাকা থেকে শ্যামলী
পরিবহনের বাস সরাসরি শিলিগুড়ি যাতায়াত করে। এছাড়াও কয়েকটি কোম্পানির বাস বুড়িমারী
যাতায়াত করে। বাসগুলির যাত্রীসেবার মান বেশ ভালো। বর্ডারে প্রত্যেক পরিবহনের যাত্রীদের
জন্যে হোটেলরুমের মতো সবার জন্যে পৃথক বিশ্রামকক্ষ আছে। বুড়িমারী বর্ডারে ‘বুড়ির
হোটেল’ নামে বিখ্যাত একটি হোটেল আছে। সেখানকার গ্রামীণ শৈলীতে রান্না করা খাবার
বেশ ভালোই লাগে।
ভারতের চেংড়াবান্ধা
থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার ট্যাক্সিক্যাব পাওয়া যায়। ট্যাক্সিক্যাবে শেয়ারেও যাওয়া যায়।
ভাড়া লাগে জনপ্রতি ১৫০ থেকে ২০০ রুপী। এছাড়া ভ্যান বা ওই জাতিয় অন্য বাহনে কিছুদূর
গিয়ে ৫০ রুপী ভাড়ায় বাসেও শিলিগুড়ি যাওয়া যায়। শিলিগুড়ি থেকে পিক-আপের মতো লম্বা
এক প্রকার জীপ গাড়ি সরাসরি কাকরভিটা যায়। ভাড়া ভারতীয়া ৮০ রুপী। সময় লাগে ঘন্টা
দেড়েক। বাংলাদেশী মূদ্রা থেকে নেপালী মূদ্রার মান সামান্য কম। তবে প্রায় কাছাকাছি।
কাকরভিটা থেকে কাঠমুণ্ড পর্যন্ত প্রকারভেদে বাসভাড়া ৪৫০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা। যাত্রাপথের
সময়কাল ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা।
‘যারা এব্যাপারে
অনভিজ্ঞ উপরোক্ত বর্ণনা বিশেষকরে তাদের জন্যে’।
‘অনলাইনে নিজে নিজে ফরম
পূরণ করার সময় একটা বিষয় ভুল করে ফেলেছিলাম। নেপাল যেতে বাংলাদেশ ও নেপালের পাশে
ভারতের দুটি বর্ডার ব্যবহার করতে হয়। সে কারনে ট্র্যানজিট ভিসায় ডবল এন্ট্রি
সিস্টেমে দুই বর্ডারের নামই উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু ভারত-নেপাল বর্ডারে ভারতের
রাণীগঞ্জ এর নাম উল্লেখ না করায় সাক্ষাৎকারের দিন ভিসা সেন্টারের সর্বোচ্চ
কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করেও কাজ হলো না। আবার নতুন করে আবেদন করে এক সপ্তাহ
অপেক্ষার পালা।
২০০৯ ও ২০১০ সালে
কোলকাতায় ঈদ উদযাপন করেছিলাম। ইচ্ছে ছিলো ২০১১ সালের ঈদূল ফিতর উদযাপন করবো
নেপালে। কিন্তু ভুলের কারণে সঠিক সময়ে ভিসা করতে না পারায় ঈদের ছুটির সময়কাল বাসায়
বসে অলস পার করতে হলো। তবে সুবিধাও একটা হয়েছিলো। বাসের টিকেট করতে ঈদের চাপ
পোহাতে হয়নি। অবশেষে ভিসা পাওয়ার নির্ধারিত দিনে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম এবং
দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে সরাসরি বাস কাউন্টা্রে চলে গেলাম।
উত্তরবঙ্গের অনেক
অঞ্চলেই বেড়িয়েছি। ১৯৭৭ সালে দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম।
এলাকার লোকদের কাছেই শুনেছিলাম তাদের এলাকার মানুষ সহজে ঢাকা যাওয়ার কথা ভাবতে
পারেনা। কারণ, তখন যাতায়াত ব্যবস্থা এখনকার মত সহজ ছিলো না। ১৯৯৮ সালে বিশ্বের
১১তম এবং এশিয়ার ৬ষ্ঠতম দীর্ঘ (৪.৮ কিঃমিঃ) বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মিত
হওয়ার পর থেকে বর্তমানে কি পরিমান গাড়ি, বিশেষ করে দূরপাল্লার বাস উত্তরবঙ্গে চলাচল
করে তা ওই পথে ভ্রমণ না করলে বোঝা যাবে না। অনেক সময় সেতুর ওপারে সিরাজগঞ্জ থেকেই
জ্যাম শুরু হয়ে যায়। যার প্রভাব পরে ঢাকায়ও।
ঢাকার কল্যানপুর থেকে এসআর ট্র্যাভেলস নামে একটি বাসের টিকেট কিনেছিলাম। যতোদূর মনে পড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে ২০১১ সালে ঢাকা-বুড়িমারী ভাড়া ছিলো ৭০০ টাকা। রাত সাড়ে আটটায় বাস ছাড়ার সময়। ওই সময়ে রাতের খাবার খাওয়ার অভ্যাস নেই তাই সান্ধ্যকালিন নাস্তা সেড়ে বাসে উঠে পড়েছিলাম। কারণ দূরপাল্লার বাসে সাধারনতঃ যাতায়াতের মাঝপথে লাঞ্চ বা ডিনারের জন্যে বিরতি দেয়। এই সুযোগে পথের কিছু কিছু নির্দিষ্ট পয়েন্টে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মত গড়ে উঠেছে বিশাল আকারের সব বিলাসবহুল হোটেল। উত্তরবঙ্গে বগুড়া শহরের আগে মহাসড়কের পাশে আঙ্গিনায় বাগানশোভিত এমন একটি হোটেল আছে নাম সম্ভবতঃ ‘হোটেল নাজ গার্ডেন’। হোটেলটির প্রাঙ্গণে ১০০ থেকে ১৫০ বাস পার্কিং-এর ব্যবস্থা আছে। হোটেলের খাদ্যমান এবং ব্যাবস্থাপনাও ভালো। বগুড়ার প্রসিদ্ধ দই তো কমন আইটেম।
বগুড়ার হোটেল থেকে আহার
শেষে বাস চলা শুরু করলো। বাস জার্নিতে আমি সাধারনতঃ ঘুমাই না। লালমনিরহাটের
পাটগ্রাম পৌঁছেই ভোরের আলো দেখা দিলো। বুড়িমারী আরো এক দেড় ঘন্টার জার্নি। বাসে
চলার সময় উত্তরবঙ্গের চমৎকার গ্রামীণ পরিবেশ দেখতে খুব ভালো লাগছিলো।
সকাল ছয়টা সাড়ে ছয়টার
দিকে বুড়িমারী পৌঁছে এসআর পরিবহনের বিশ্রামকক্ষে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম। সকাল ১০ টার
আগে বর্ডার খুলবে না। বিশ্রামকক্ষে গোসলের ব্যাবস্থাও আছে। স্থলবন্দরে চলাচলরত
পরিবহন কোম্পানিগুলোর এমন ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
বাংলাদেশ বন্দরের
আনুষ্ঠানিকতা সেরে বর্ডার চেকিং পয়েন্টে পৌঁছে দেখি সময়ের তারতম্যের কারণে (৩০মিঃ)
তখনও ভারতীয় কর্মকর্তারা এসে পৌঁছেনি।
বর্ডারে লাইনে দাঁড়িয়ে
একটা লোক বারবার আমার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলো। আমারও লোকটাকে চেনা চেনা
লাগছিলো কিন্তু কোনো রকম মনে করতে পারছিলাম না। অবশেষে ভেবে নিলাম, একই আবহাওয়ায়
বেড়ে ওঠা দেখতে প্রায় কাছাকাছি অনেক লোকইতো থাকতে পারে।……….........(চলবে)
(ঘটনা ২০১১ সালের। ২০১৪ সালের লেখা)