গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-২২)

 



বাংলাদেশী পর্যটকরা কোলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল দেখতে যেতে ভুলবেন না। সেখানে মোগল পাঠানদের আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমল ও তার পরবর্তী সময়ের অনেক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। হাতে লেখা বিরাট আকারের একটি কোরআন শরীফও সেখানে সংরক্ষিত আছে। হলের প্রবেশ মূল্য ভারতীয়দের জন্যে দশ টাকা, বিদেশী পর্যটকদের জন্যে পঞ্চাশ টাকা। তবে বাংলাদেশী পর্যটকরা দেশীয় হিসেবে টিকেট নিলেও কেউ আপত্তি করেনা।

 

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল যাদুঘর হলেও হল সংলগ্ন পার্কেও অবকাশ যাপনের সুযোগ আছে। পার্কে বসেই পরিচয় হলো ঝাড়খণ্ডে কর্মরত এক ভারতীয় পুলিশ অফিসারের সাথে। সুদর্শন চেহারার পুলিশ অফিসার স্বপরিবারে কোলকাতা বেড়াতে এসেছেন। চেহারা দেখে মনে হয়নি তার মনে কোন কষ্ট আছে। হঠাৎ নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি তার একটি পা কৃত্রিম। ঝাড়খন্ড বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে যুদ্ধে পা’টি খুইয়েছেন। এখন অবশ্য ঝাড়খন্ড একটি আলাদা রাজ্য।

 

মেমোরিয়াল হল সংলগ্ন পার্ক ছাড়াও হলের উল্টোদিকে বিরাট মাঠে সবাই ঘোড়দৌড় শিখছে। কেউ দেখছে। তার পাশেই ময়দান নামক বিরাট মাঠ আছে যেখানে ইচ্ছেমত ঘুরেফিরে মানুষ শহুরে জীবনের একঘেয়েমী কাটিয়ে কিছুটা প্রাকৃতিক পরিবেশের আস্বাদন উপভোগ করতে পারে। ঢাকা শহরে অতোবড় সরকারী মাঠ কোথায়ও নেই।

 

কোলকাতার ঐতিহ্যবাহী যানবাহন ট্রাম ও টানা রিকশার এখন আর তেমন কদর নেই। ১৯৭১ সালে আমাদের ঢাকা শহরের মতই অনেক রিকশা দেখা যেতো। তবে তা প্যাডেল মেরে চালানো রিকশা না, মানুষ দ্বারা টানা রিকশা। এখন তা বিলুপ্তপ্রায়। শুধু পর্যটকদের কৌতূহল বা শখ মেটানোর জন্যে অলিগলিতে হঠাৎ দু'য়েকটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। প্রধান সড়কে চলার অনুমতি নেই। ট্রাম লাইনগুলো আছে। তবে আগের মতো আর ট্রাম চলতে দেখা যায় না। ১৯৭১ সালে ১০ পয়সা দিয়ে সারা কোলকাতা শহর পরিভ্রমণ করা যেতো যতক্ষণ না ট্রাম থেকে নামা হতো।

 

আগে দেখেছি ট্রাম আসতে দেখলে রাস্তার অন্যান্য যানবাহন দাঁড়িয়ে তা যাওয়ার সুযোগ করে দিতো। কারণ ট্রাম চলে রেল লাইনের মত নির্দিষ্ট লাইনের উপর দিয়ে বিদ্যুতের সাহায্যে। এখন নগরের কিছু কিছু অঞ্চলে ট্রাম চলে। তবে বাসের দাপটে ট্রামকেই অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে পড়তে হয়।

 

এখন নগরবাসীর তড়িৎ যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম পাতাল রেল। এক অন্যরকম অনুভুতি। পাতাল রেলে যাতায়াত না করলে কোলকাতার বর্তমান কৌলিন্য সম্বন্ধে অজানা থেকে যাবে। অফিস বা কলঞ্জ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী অধিকাংশ যাত্রীই এখন পাতাল রেলে যাতায়াত করে। দশ পনর মিনিটের ব্যবধানে একেকটি ট্রেন যাতায়াত করছে। প্রত্যেক বগীতে মহিলা, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্দীদের জন্যে আলাদা সিট আছে। দমদম থেকে গড়িয়া পর্যন্ত শহরের প্রধান অংশে মাটির নিচ দিয়ে এবং কিছু অংশ উড়াল সেতুর উপর দিয়ে সাবওয়ে রেল লাইন। প্রতিটা ষ্টেশনের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে যেমন; বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহানায়ক উত্তম কুমার এবং আরো অনেকের নামে। শহরের প্রধান এলাকা ধর্মতলার ষ্টেশনটির নাম ‘কবি নজরুল’। স্প্লানেডও বলে।

না জানলে সহজে বোঝার উপায় নেই, এখানে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেই আরেক শহর অর্থাৎ পাতাল রেলের বিরাট ষ্টেশন।

 

কোলকাতায় ডাক্তার দেখিয়ে, ছয় সাতদিন বেড়িয়ে অবশেষে বাড়ি ফেরার পালা। যথারীতি শিয়ালদহ রেল ষ্টেশন, নির্ধারিত সময়ে ট্রেন এবং সকাল সারে এগারোটার মধ্যে গেদে বর্ডার ক্রস।

 

বর্ডারে সাহায্যকারীদের সাথে সম্পর্ক রাখলে কিছু সুবিধাও পাওয়া যায়। পশ্চিম বাংলার ভূখন্ডে বসেই বাংলাদেশী সিম কার্ড লাগিয়ে তাদের সাথে কথা বললে তারা আমাদের জন্যে একটা রেন্ট-এ কার এর ট্যাক্সি ঠিক করে রাখে। সেটাতে আসতে পেরে বেলা আড়াইটায় কুষ্টিয়া পৌঁছে দুপুরের আহার। তারপর দৌলতদিয়াগামী বাসে সন্ধ্যার আগেই রাজবাড়িতে নিজ বাড়ি।

 

 “গল্পের মাঝে ঘটনার আলোকে নিজস্ব কিছু বিশ্লেষণ, অভিমত, সুপারিশ ব্যক্ত করি। আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানের অভিমত বিশ্লেষণ শতভাগ সঠিক হবে এমন নয়। তাই পাঠক বন্ধুরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশাকরি”।

 

পরপর দুবছর বেড়িয়ে- বেড়ানোর একটা নেশায় পেয়ে বসলো। আগে সামর্থ থাকলেও সুযোগ ছিলো না। সন্তানরা ছোটো ছিলো। সবাইকে নিয়ে একসাথে বেড়াতে যাওয়ার জন্যে যা কিছুর সমন্বয় বা সংগতির দরকার তাও অনুকুলে ছিলো না। সন্তানরা বড় হওয়ায় আমরা একটু ফ্রি হয়ে গেলাম। তারাও উৎসাহ দিতে লাগলো আমাদের বেড়ানোর ব্যাপারে। তাই ২০১১ সালেও সিদ্ধান্ত নিলাম স্বামী স্ত্রী মিলে নেপাল বেড়াতে যাবো।

 

আগেই বলেছি, দক্ষিণ কোরিয়ার ইমিগ্রেশন প্রসেসিং সেন্টারে থাকতে নেপালী এক ছেলের সাথে বেশ আন্তরিকতা গড়ে উঠেছিলো। নেপাল থেকে সব সময় সে সড়কপথে কোলকাতা যাতায়াত করে থাকে। তার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েই নেপাল বেড়ানোর ইচ্ছা মনে পুষে রেখেছিলাম এবং মনে মনে সড়কপথের একটা চিত্রও এঁকে রেখেছিলাম।

 

ঢাকা-কাঠমুণ্ডূ বিমান ভাড়া যদিও বেশি না, তবুও বিমানে উড়ে গেলে তো আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। উড়ে গিয়ে নামলাম আবার উড়াল দিয়ে চলে এলাম, লাভের মধ্যে বিমান ভ্রমণ। কিন্তু ভ্রমণের আসল উদ্দেশ্য সফল হয় না। আবার এক পথ বিমানে একপথ সড়কে ভ্রমণ করারও সুযোগ নেই। ভিসার সিস্টেম অনুযায়ী যে পথে গমন সে পথেই আগমন করতে হবে। অবশ্য ডবল বা মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা নিলে সে সুযোগ পাওয়া যায় কি না আমার সঠিক জানা নেই।

 

বাংলাদেশ থেকে ভারতের ভেতর দিয়ে সড়কপথে অন্য দেশে যেতে হলে ভারতীয় দূতাবাস থেকে ট্র্যানজিট ভিসা নিতে হয়। ট্র্যানজিট ভিসার মেয়াদ থাকে মাত্র ৭২ ঘন্টা। তার আগে যে দেশে যেতে ইচ্ছুক সে দেশের ভিসা নিতে হবে। নেপালে যদিও বাংলাদেশিদের জন্যে পোর্ট এন্ট্রি ভিসা সিস্টেম, কিন্তু ভারতের মাটি ব্যবহার করলে সে সুযোগটি আর কাজে লাগানো যায় না। তবে ভারতের ভ্রমণ ভিসা নিয়ে অনেকেই নেপাল বেড়িয়ে আসতে পারে।

 

ভারতীয়দের জন্যে নেপাল যেতে কোন ভিসা লাগেনা। সে কারণে বর্ডারে তেমন চেকিংও নেই। শুধু কোনো যানবাহন অর্থাৎ মটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ইত্যাদি নিলে তা বর্ডারের নিরাপত্তা বুথে লিখিয়ে যেতে হয় (শুধু ভারতীয়দের জন্যে)।

 

শিলিগুড়ি থেকে নেপালের বর্ডার সংলগ্ন শহর কাকড়ভিটায় কাঠমুণ্ড, পোখরার বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত অনবরত ভারতীয় ভাড়ার গাড়ি চলাচল করে। এভাবে গেলে অনায়াসেই ভারতে গিয়ে নেপালও বেড়িয়ে আসা যায় যেটা সেই নেপালী বন্ধুর কাছ থেকেই জেনেছিলাম। তবে সেটা আইনসংগত নয়। আমি একজন সরকারি ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধা এবং পেনশনভোগী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী হয়ে সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করার মোটেও অবকাশ নেই। তাছাড়া সত্য ও বৈধ পথ ব্যতীত জীবনে বক্রপথে চলার কথা কোনোদিন মাথায় আনিনি।

অতএব, ভ্রমণের বৈধ কাগজপত্র সংগ্রহ করেই তবে যাবো। কিন্তু এ বিষয়ে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় স্মরণাপন্ন হলাম ভিসা সহায়তাকারীদের। একজন আমার বর্ণিত পদ্ধতিতে যেতে সস্তা পরামর্শ দিলো। অবশেষে দূতাবাসের ওয়েব সাইটে দেয়া ভিসা পদ্ধতি জেনে নিজে নিজেই নেপাল ও ভারতীয় দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহ করেছিলাম……………….........(চলবে)

 (২০১৪ সালের লেখা)

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url