গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-২১)
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ফিরে
এসে বাড়িতেই অবস্থান করছিলাম। কোম্পানির ব্যবসায়িক কাজে গিয়ে সঠিক সময়ে না আসায় তাদের
কাছে আমার আর গ্রহণযোগ্যতা আছে কিনা তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। যদিও না আসার বিষয়টি সাধুতার
সাথেই কোম্পনিকে জানিয়েছিলাম। অবশেষে কোম্পানি থেকেই খবর পেলাম পূন:যোগদানের। মনে মনে
তৃপ্ত হলাম এই ভেবে যে, বিগতদিনের বিশ্বস্ততা ও কর্মদক্ষতার পুরস্কার পেলাম।
‘কোলকাতা ভ্রমণের বাল্যকালে
সুপ্ত বাসনা বর্ণনা করতে গল্প শুরু করেছিলাম। ১৯৭১ ও ২০০৯ সালে কোলকাতা বেড়ানোর গল্প
বলতে বলতে এক পর্যায়ে একটু পিছনে গিয়ে বন্ধুদেরকে সিউল থেকে ঘুরিয়ে আনলাম। ফের কোলকাতা,
কাঠমুন্ডু ও দার্জিলিং বেড়ানোর গল্প শোনার জন্যে বন্ধুদেরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। কিন্তু
পরিপক্ক লেখিয়ে তো আর নই। তাই কিভাবে শুরু করবো ভেবে পাচ্ছিনে’।
২০০৯ সালে হঠাৎ করে কোলকাতা
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় স্ত্রীকে সাথে নিতে পারিনি, কারণ তার পাসপোর্ট ছিলোনা। সে
তার পিতার সাথে শৈশবে ১৯৭৪/৭৫ সালে শেষবারের মতো কোলকাতা বেড়িয়ে এসেছে। ছোটোবেলায় বেড়ানোর
স্মৃতি ঝালাই করতেই তারও যথেষ্ট আগ্রহ ছিলো কোলকাতা যাওয়ার। সে কারণে পরের বছরই তাকে
নিয়ে পূনরায় কোলকাতা যাই। যদিও কোলকাতা বেড়ানোর কাহিনী ইতোপূর্বেই বর্ণনা করেছি,- তবুও
দু’একটি নতুন অভিজ্ঞতা শুনানোর অভিপ্রায়ে গল্পের পূরাবৃত্তি।
স্ত্রীও শৈশবে দর্শনা-গেদে
হয়েই কোলকাতা গিয়েছিলো, তাই তারও আগ্রহ সে পথেই যাওয়ার। বেসরকারি প্রাইভেট কোম্পানিতে
মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করার কারণে সারা বছর তেমন ছুটি ভোগ করতে পারতাম না।
ফলে ২০১০ সালেও ঈদুল ফিতরের দিনদুয়েক আগে রোজার মধ্যেই রওনা দিতে হলো।
কমলাপুর থেকে সুন্দরবন এক্সপ্রেস-এর
শোভন চেয়ারের টিকেট না পেয়ে শোভন সাধারণ শ্রেণীর টিকেট কাটতে হয়েছিলো। ট্রেনটি ছাড়ার
সময় প্রত্যুষে। অতো সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে ট্রেন ফেল করার ভয়ে আগেরদিন খানিক এগিয়ে
উত্তরায় মেয়ের বাসায় গিয়ে অবস্থান নিয়েছিলাম।
উত্তরা থেকে এয়ারপোর্ট ষ্টেশন
কাছে। ট্রেনের সময়ও একঘন্টা পরে। কিন্তু সকালে নির্দিষ্ট সময়ে ষ্টেশনে পৌঁছেই শুনি
ট্রেন তিনঘন্টা লেট। অতএব, উল্টোদিক থেকে ট্রেন আসার অপেক্ষায় থাকলাম। তিনঘন্টা পর
ট্রেন এলে বিমানবন্দর ষ্টেশন থেকে কমলাপুর অভিমুখে যাওয়ার সময় অনায়াসেই নিজের নির্ধারিত
সিটে গিয়ে বসলাম। কিন্তু তামাশা শুরু হলো কমলাপুর ষ্টেশনে গিয়ে। আন্তঃনগর ট্রেন অথচ
দাঁড়ানো যাত্রীরও টিকেট দিয়েছে। সেই সুযোগে কতো লোক যে বিনা টিকেটে গেলো তার হিসেব
নেই। আবার মানবিক কারণে দুইজনের সিটে চাপাচাপি করে তিনজন বসতে হলো।
বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর উপর
দিয়ে খুব আস্তে আস্তে ট্রেন যাচ্ছিলো। যমুনা সেতুর উপর দিয়ে সেটাই প্রথম যাওয়া। পাঁচ
মিনিটের পথ আধঘন্টা লাগলো সেতু পার হতে। যেতে যেতে একটা কথাই মনে হলো, সঠিক পরিকল্পনার
অভাবে সেতুর একপাশে রেল লাইন স্থাপন করে মারাত্মক ভুল করেছে এদেশের কর্ণধাররা। যে সেতু
হয়তো ১০০ বছর স্থায়িত্ব পেতো সেটা ৫০ বছরও পায় কি না সে সন্দেহ উড়িয়ে দেয়া যায়না।
আরেকটি বিষয় মনে হয়েছে;
ঢাকা আরিচা রোডের নয়ারহাট ও তরা সেতু নির্মিত হয় ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে।
নয়ারহাটের টোল বন্ধ হলেও তরা সেতুর টোল অদ্যাবধি আদায় করা হচ্ছে, যা অস্বাভাবিক বলেই
মনে হয়। অতএব, বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর আহরিত টোল যাতে সঠিকভাবে সংশ্লিষ্ট তহবিলে জমা
হয় এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই ধার-দেনা শোধ করে সেতুর অবকাঠামো পূনঃনির্মাণ করা হয়,
সে বিষয়টির প্রতি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তি তথা দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের সজাগ
দৃষ্টি রাখা উচিত।
বঙ্গবন্ধুর নামে সেতু। অতএব,
কোনোদিন যাতে বড় কো্নো দুর্ঘটনার খবর শুনতে না হয়।
যে ট্রেন বিকেল পাঁচটা নাগাদ
খুলনা পৌঁছার নির্ধারিত সময় সে মোতাবেক দর্শনা পৌঁছার কথা বেলা একটা বা দুইটায়। আমাদের
টার্গেট ছিলো ভারতে প্রবেশ করে ইফতার করবো। কিন্তু সে ইফতার করতে হয়েছিলো ঈশ্বরদী ষ্টেশনে।
অতঃপর রাত সাড়ে সাতটা আটটা নাগাদ দর্শনা পৌঁছতে সক্ষম হলাম। ততোক্ষণে বর্ডার সিল। অগত্যা
এক দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাসায় রাত্রিযাপন করতে হলো। যাতায়াত ব্যবস্থার দুরবস্থার
কারণে ভ্রমণের সময়কাল থেকে একটা দিন খসে পড়লো।
পরের দিন সকালে বর্ডারের
আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যে শিয়ালদহ রেল ষ্টেশন এবং একটা-দেড়টার মধ্যে
ধর্মতলা ফ্রি স্কুল ষ্ট্রীটের হোটেল গুলিস্তানে পৌঁছে গেলাম।
সড়কপথে নতুন বেড়াতে যেতে
ইচ্ছুক বন্ধুদের জন্যে একটা কথা বলে রাখি। বর্ডারে ট্র্যাভেল ট্যাক্স জমা দিতে অনেক
ঝামেলা পোহাতে হয় এবং সময়েরও অপচয় হয়। তাই ভিসা নেয়ার পর যাত্রা শুরুর আগেই ঢাকা বা
অন্যান্য শহরের সরকার অনুমোদিত ব্যাংকে ট্র্যাভেল ট্যাক্স জমা দেয়ার কাজটি সেরে নিলে
ভালো হয়।
পশ্চিম বাংলায় প্রবেশ করেই
ফোনে আগের পরিচিত হোটেল গুলিস্তানে রুম বুকিং দিয়েছিলাম। রোজা রেখে ক্লান্ত শরীরে কোথায়ও
না বেরিয়ে ইফতারের সময় পর্যন্ত ঘুমিয়ে বাইরে বেরুলাম দু’জন ইফতার করতে।
কোলকাতার নিউ মার্কেট এলাকা
মুসলিম জনবহুল এবং পর্যাপ্ত মুসলিম হোটেল বিদ্যমান। এক হোটেলে বসে অনায়াসেই দেশীয় কায়দায়
‘বীফ কাবাব’ ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে তৃপ্তি মিটিয়ে ইফতার করলাম। পরের দিন হোটেলের নিকটেই
এক মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ে তারপর ঘুরতে বেরুলাম।
গরীবানা ভ্রমণে দুইজন একসাথে
বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রী হলে থাকা খাওয়ার একটা সুবিধা আছে। সিঙ্গেল রুমে থাকা সেইসাথে
রেঁস্তোরায় খাবার আইটেমগুলোও প্রয়োজনে ভাগাভাগি করে খাওয়া যায়।
একটা বিষয় সবাইকে মাথায়
রাখতে হবে। কোনো দর্শনীয় স্থানে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে নিজের সঙ্গীকে যাতে হারিয়ে না ফেলেন
সেজন্যে আগেভাগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি নিজে এর ভুক্তভোগী। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে কোলকাতার
‘সায়েন্স সিটিতে’ বেড়াতে গিয়ে ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গেট দিয়ে বেরোনোর
সময় ভিড়ের মধ্যে দু’জন দু’দিকে চলে গেছি। পরে অবশ্য দু’জনই উলটা ঘুরে একই জায়গায় ফিরে
গিয়ে উভয়ে উভয়কে পেয়েছিলাম।
‘হোটেলের ভিজিটিং কার্ড
বা মোবাইল ফোন কোনোটাই স্ত্রীর কাছে ছিলোনা। তাই আমার মতো ‘আবুল’ না হয়ে বেড়াতে
গিয়ে যে হোটেলেই ওঠেন তার ভিজিটিং কার্ড উভয়ের সাথে রাখলে ভালো। তবে আজকাল প্রযুক্তির
যুগে মোবাইল ফোন সাথে রাখাটাই উত্তম। আজকাল সবাই সাথে মোবাইল ফোন রাখে। অতএব, গিয়েই
উভয়ের জন্যে সে দেশের সিম কার্ড সংগ্রহ করে তার নম্বর উভয়ের সেটে সাথে সাথে সেভ করে
নিতে হবে। তবে ইন্ডিয়ার বর্ডারে বিএসএফ-এর চেকিং এর আগে দেশীয় সিম কার্ডটি খুলে ফেলতে
হবে। মোবাইলে সিম কার্ড লাগানো অবস্থায় পেলে ওরা খুলে ভেঙ্গে ফেলবে (২০০৯-১০ সালে
এ নিয়ম থাকলেও এখন সে নিয়ম নেই)’।
সায়েন্স সিটিতে যাওয়ার সময়
এক কান্ড! স্ত্রীকে নিয়ে দুই তিনদিন পিয়ারলেস হাসপাতালে গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্যে।
একদিন সেখান থেকে বেরিয়ে অদূরেই এক হোটেলে দুপুরের খাবার খাচ্ছি। খেয়েই সায়েন্স
সিটিতে যাবো। পাশেই এক ভদ্রলোক খাবার খাচ্ছিলো। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি জেনে খুব আলাপ
জমালো। ঢাকায় তার আত্মীয় আছে, ঢাকায় বেড়িয়ে গেছে, ঢাকা শহরের অনেক উন্নতি হয়েছে ইত্যাদি।
খাবার খেতে খেতে হোটেল মালিককে সায়েন্স সিটিতে যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করলে ভদ্রলোক
বললো, চলেন আমি দেখিয়ে দেবো। ভয় পাচ্ছিলাম, সেও আদিখ্যেতার কমতি করছিলো না।
খাবার হোটেল থেকে বেরিয়ে
দেখলাম সে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং তার ট্যাক্সিতেই উঠতে অনুরোধ করছে। হোটেল মালিকও
বললো, যান অসুবিধে নেই। ভেবেছিলাম, খেতে বসে একজন যাত্রী পেলো ওটাই ওর আদিখ্যেতা দেখানোর
কারণ। তবে গাড়িতে চলার সময় ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে অন্য কোথায়ও নিয়ে যায় কি না! কারণ স্ত্রীর
কাছে সামান্য সোনার গহনা ছিলো। কিন্তু বেশ কিছু দূরে সায়েন্স সিটিতে গিয়ে যখন নামালো,
অনেক অনুরোধ করেও তাকে ভাড়া দিতে পারলামনা…………….........(চলবে)