বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা একজন মুসলিম নারী

 


Fatima Al-Fihri Al-Quaesi


“আল-কারাওইয়িন বিশ্ববিদ্যালয়” পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। মরক্কোর ফেজে গড়ে ওঠা এটি প্রাচীন সময়ের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র। ইউনেস্কো এবং গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে, মরক্কোর ফেজে অবস্থিত আল-কারাওইয়িন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। ৮৫৭ বা ৮৫৯ সালে ফাতিমা মুহাম্মদ আল ফিহরি এটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রথমে মসজিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এবং পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে ওঠে।

 

জীবনী

ফাতিমা আল ফিহরি (৮০০-৮৮০) ডাকনাম উম্মুল বানিন (অর্থাৎ সন্তানের মা) ছিলেন একজন আরব মুসলিম নারী। আনুমানিক ৮০০ খৃষ্টাব্দে বর্তমান তিউনিসিয়ার কাইরাওইয়িন শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ আল ফিহরি আল কুরাইশী ছিলেন একজন ধনী ব্যবসায়ী। তাদের পারিবারিক নামের কুরাইশি অংশ থেকে ধারণা করা হয়, তারা ছিলেন কুরাইশ বংশের উত্তরাধিকারী।

 

ফাতিমা আল-ফিহরির আরেকটি বোন ছিলো, নাম মারইয়াম আল-ফিহরি। শৈশব থেকে তারা দুজনই পড়াশোনার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে তাদের নিয়ে জন্মভূমিতে স্থায়ী হতে পারেননি তাদের পিতা মোহাম্মদ আল-ফিহরি। ভাগ্যের অন্বেষণে কারাওইয়িনের আরো বেশ কয়েকটি পরিবারের সাথে তিনিও সপরিবারে পাড়ি জমান ইসলামিক মাগরিব তথা মরক্কোর প্রসিদ্ধ শহর ‘ফেজের’ উদ্দেশে। ‘ফেজ’ ছিল তখন ক্রমবর্ধমান কসমোপলিটন বা বহু মতাদর্শের মানুষের শহর। নানা দেশ থেকে নানা ধর্ম, বর্ণ ও পেশার মানুষ সেখানে এসে বসতি স্থাপন করছিলো। কারাওইয়িন থেকে সমাগত অভিবাসীরা ফেজে এসে নতুন পরিচয় পায় ‘কারাউইয়িনের’ অধিবাসী নামে।

 

‘ফেজে’ এসে মোহাম্মদ আল-ফিহরির ভাগ্য খুলে যায়। প্রচণ্ড পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার সন্তানদের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ফাতিমা আল-ফিহরি এবং তার বোন মারইয়াম আল-ফিহরি আরবি ভাষা, ইসলামিক ফিকহ (আইন শাস্ত্র) এবং হাদিস শাস্ত্রের ওপর পড়াশোনা করেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর এই ফেজেই এক যুবকের সাথে ফাতিমার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের কয়েক বছরের মাথায়ই ফাতিমাদের পরিবারে ‘মহাদুর্যোগ’ নেমে আসে। অল্প সময়ের মধ্যেই তার বাবা, ভাই এবং স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। রয়ে যান কেবল এতিম দুই বোন ফাতিমা এবং মারইয়াম। বাবার রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণ সম্পদের উত্তরাধিকারী হন তারা।

 

কারাওইয়িন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

ফাতিমা ও তার বোন মারইয়াম উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তাদের মৃত পিতার সম্পদ বিলাসিতার পেছনে নষ্ট না করে তা ধর্ম ও মানবতার কল্যাণে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের পিতার জন্য ওয়াকফ হিসেবে মসজিদ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। প্রথমে তারা ফেজে পৃথক দু’টি মসজিদ নির্মাণ করেন। মারইয়াম নির্মাণ করেন ‘আন্দালুস মসজিদ’, আর ফাতিমা নির্মাণ করেন ‘কারাওইয়িন মসজিদ’।

মসজিদের পাশেই ফাতিমা নির্মাণ করেন একটি মাদ্রাসা। পরবর্তীতে এটিই হয়ে ওঠে একটি পূর্ণাংগ বিশ্ববিদ্যালয়।

The University of al-Qarawiyyin



৮৫৭/৮৫৯ সালে ফাতিমা উচ্চশিক্ষায় বিশ্বের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী প্রদানকারী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। এর ব্যাপক সুনাম ‘গার্বার্ট অব অভার্গনেকে’ এখানে শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত করে। অভার্গনে পরবর্তীতে পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার হন। ইউরোপে আরবি সংখ্যা পদ্ধতি ও শূণ্যের ধারণার প্রচলন করার জন্য তাকে কৃতিত্ব দেয়া হয়।

 

ঐতিহাসিক এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিবৃত্ত

এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনে আবি জারার বিবরণ থেকে জানা যায়, ফাতিমা ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের ৩ তারিখে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। সেটা ছিল পবিত্র রমজান মাস। তিনি শুধু মসজিদ নির্মাণের জন্য অর্থ দান করেই নিজের দায়িত্ব শেষ করেননি। নিজে সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত থেকে এর নির্মাণকাজ তদারকি করেছেন। এবং প্রথম দিন থেকে শুরু করে নির্মাণ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি দিন তিনি রোজা রেখেছেন।

নির্মাণকাজ শেষ হলে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করেন ফাতিমা এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। জন্মভূমি কারাওইয়িনের নামানুসারে তিনি মসজিদটির নাম রাখেন কারাওইয়িন মসজিদ।

 

মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর ফাতিমা মসজিদের বর্ধিতাংশে একটি মাদরাসা নির্মাণ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই সেখানে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি ব্যাকরণ, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, রসায়ন, ভূগোলসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান শুরু হয়। বৈচিত্র্যময় বিষয়ের ওপর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ডিগ্রী প্রদানের প্রচলনও চালু হয়। এভাবেই মসজিদ থেকে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তনের ইতিহাস রচিত হয়।

 

ফাতিমা আল-ফিহরি ৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত কারাওইয়িন মসজিদ ও ইউনিভার্সিটি এবং লাইব্রেরি আজও দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী এগুলো মানব সম্প্রদায়কে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে চলেছে অবিরাম।

 

উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন সূত্র থেকে সংকলিত

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url