গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-১৯)

 



সিউল বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন প্রসেসিং সেন্টার একটা মিনি জেলখানায় পরিনত হয়েছিলো। এখনও তেমন আছে কি না জানিনা। ওই সময় দেখেছিলাম অপরাধ সংঘটনকারী বা অবৈধ অবস্থানকারী বিভিন্ন দেশের পাগলাটে লোকজনের এক গারদখানা।

 

‘১৯৯১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী হত্যাকান্ডের পর সন্দেহের দৃষ্টিতে ছিলো ভারতীয় ও শ্রীলংকান তামিলরা। সে কারণে শ্রীলংকার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম(LTTE)’-এর অসংখ্য সদস্য জীবনরক্ষার জন্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো। তারা এতো উগ্র স্বভাবের ছিলো যে, তাদের গতিবিধিতে একটা যুদ্ধংদেহী মনোভাব লক্ষ্য করা যেতো। যে কোনো  ছুতোয় হট্টগোল বাধিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত করে তুলতো।

 

একদিন এমনি এক হট্টগোলের আওয়াজ কানে এলে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম শান্তশিষ্ট এক কোরিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসারের সাথে এক শ্রীলংকান তামিল তুমুল ঝগড়া করছে এবং খুব আস্ফালন দেখাচ্ছে।

 

‘একজন বিদেশি অপরাধীর আস্ফালনে অধৈর্য হয়ে এক পর্যায়ে ইমিগ্রেশন অফিসার কোমড় থেকে পিস্তল বের করে তার বুক বরাবর তাক করলে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু তামিল লোকটি তার পরিধেয় ব্লেজার ফাঁক করে বুক এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘পারবে তুমি আমাকে গুলি করতে? পারলে করো’। আমরাতো ভয়ে উদ্বিগ্ন। কুত্তা খাওয়া বদমেজাজী জাতি, গুলি কি করেই দেয়’!

শেষ পর্যন্ত তামিল লোকটার সাহসের কাছে পরাজিত হয়ে পিস্তল নোয়াতে হয়েছিলো কোরিয়ান অফিসারের।

 

‘অন্য একদিন ডাইনিং হলে বসে এক কান্ড! ‘প্রসেসিং সেন্টারে ঢুকে এই প্রথম বাধ্য হয়ে কোরিয়ান খাবার খেতে হচ্ছিলো। মশলা ছাড়া রান্না করা সামুদ্রিক শ্যাওলাসহ আবোলতাবোল সব অচেনা তরকারী দিয়ে ভাত খেয়ে কোনমতে জীবনধারণ করছিলাম। সন্ধ্যাবেলায়ই সেদেশে রাতের খাবার খেয়ে নেয়’।

 

‘একদিন সন্ধ্যায় খাবার খেতে গিয়ে পেলাম আলুঘন্ট জাতীয় সুস্বাদু এক প্রকার তরকারী। স্বাদ পেয়ে অনেকের সাথে আমিও গোগ্রাসে খাচ্ছি। এমন সময় দেখলাম বিরাট হলঘরের মতো ডাইনিং হলের এক প্রান্তে কিছু লোক টেবিলে প্লেট আছড়াআছড়ি করছে এবং কিছু লোক প্লেট উপুড় করে রেখে চেঁচামেচি করছে’।

 

অর্ধ খাওয়া অবস্থায় খাবার রেখে এগিয়ে গেলাম তাদের কাছে। আলুঘন্টের মধ্যে অল্পস্বল্প মাংশ ছিলো 'যা আমরা টের পাইনি। সেগুলো নাকি শুকরের মাংস এবং সেজন্যেই তারা খাবার না খেয়ে প্রতিবাদ করছে যে, না জানিয়ে কেনো মুসলিমদেরকেও শুকরের মাংস খাওয়ানো হচ্ছে।

 

‘সেদিনও অর্ধ ভুক্ত অবস্থায়ই খাবার শেষ করে উঠে আসতে হয়েছিলো। পরে অবশ্য পাকিস্তানিদের আশংকারই সত্যতা মিলেছিলো। পরে সে রাতে মুসলিমদের জন্যে কলা পাউরুটি সরবরাহ করা হয়েছিলো’।

 

‘অন্য আরেকটি ঘটনা। স্বাভাবিক কারণে মানুষ যে অন্যদের সামনে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হতে পারে তা প্রথম দেখলাম সিউল ইমগ্রেশন প্রসেসিং সেন্টারে। কোরিয়ার কর্মস্থলে এক রুমে একা থাকতাম এবং সেখানে পরিপাটি গোসলখানা ছিলো। কিন্তু প্রসেসিং সেন্টারে দেখতাম খোলা গোসলখানার সারি সারি শাওয়ারে ফিলিপাইন, চীন, নাইজেরিয়া সেইসাথে বাংলাদেশের কিছু ছেলে সবার সামনে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় গোসল করতে’।

 

‘মফঃস্বল এলাকায় কাজ করতো এমন এক বাংলাদেশি ছেলের মুখে পরে শুনেছি, কোরিয়ানরাও নাকি মেয়ে পুরুষ এক ঘাটে গোসল করার সময় পুরুষরা সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে গোসল করে এবং সেখান থেকে সে নিজেও ওই অভ্যাস রপ্ত করেছে’।

 

‘প্রসেসিং সেন্টারে কয়েকজন ইরানী নাগরিকের সাথে কথা হয়েছিলো। আমরা একই রুমে থাকতাম। ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে নাকি তারা নিজ দেশে সুবিধা করতে না পেরে দলবেঁধে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন হয়ে কোরিয়ায় এসেছিলো ‘নারী অঙ্গের’ উপর পিএইচডি(!) করতে। আন্তর্জাতিক লাইসেন্স ছাড়া সিউলের রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে (ওদের ভাষ্য অনুযায়ী) অবশেষে ‘কট’।

 

‘একই রুমে কয়েকজন নেপালীও ছিলো। তাদের সাথেই আমার বেশি সখ্যতা গড়ে ওঠে। নেপালী এক ছেলের কাছে শুনেছিলাম, ওদের ভাষার নাকি নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। হিন্দী বর্ণমালায়ই ওদের ভাষার পড়ালেখা চলে। তার কাছ থেকে হিন্দী বর্ণমালা শিখতে গিয়ে দেখলাম, অক্ষরগুলোর উচ্চারণ বাংলার সাথে অনেকটা মিল। শুধু ‘র’ অক্ষরগুলো নেই’।

 

পূন:পূন: নেপালীদের সাথে পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা থেকেই নেপাল ভ্রমনের বাসনা মনে দানা বাঁধে।………………….........(চলবে)

 

 (২০১৪ সালের লেখা)

 

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url