গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-১৮)

 



‘সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরিমানমতো দেড় বা দুইটা মুরগি রান্না করে রেখে দিতাম। ফ্রিজে না রাখলেও মাইনাস শীতের কারণে তা নষ্ট হতো না। অন্যদিকে রাইস কুকার কোনোদিন বিদ্যুৎ থেকে বিযুক্ত করতাম না’।

 

‘কোরিয়াতে কোনো সিদ্ধ চাউলের প্রচলন নাই। বাজারে যে আতপ চাউল পাওয়া যেতো তা কাচের মতো ঝকঝক করতো। ভাতও হতো খুব মোলায়েম এবং খেতে সুস্বাদু। কুকারে ভাত কমে এলে বা ফুরিয়ে গেলে তারমধ্যেই কিছু চাউল এবং পানি দিয়ে ওভাবেই রেখে দিতাম। কুকারে রেখে অন্য জায়গায় বেড়াতে গিয়ে ২/৩ দিন পরে এসেও কুকার থেকে গরম ভাত খেতে পারতাম। তবে ২/৩ দিন থাকায় অনেক সময় ভাত শুকিয়ে যেতো। সেক্ষেত্রে ভাতের মধ্যে একটু পানি দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে ভাতগুলো স্বাভাবিক হয়ে যেতো। খাওয়ার সময় শুধু মাংসটা গ্যাসের চুলায় গরম করে নিতে হতো। প্রতিদিন দু’বেলা মুরগির মাংশ, সকালে মুরগির ডিম ভাজি খেয়েই কাটাতাম। মাঝে মাঝে ইলিশ মাছের মতো বড় এক ধরণের চাপিলা মাছ এনে পালং শাক দিয়ে রান্না করে খেতাম, যেটা পূর্বেই বলেছি’।

 

টাকা পাঠানো নিয়ে বেঈমানী, শুয়োরের মাংস খাওয়া ইত্যাদি কারণে বাবুর উপরে বিশ্বাস একেবারে জিরোতে নেমে এলো। অমন মানুষের সাথে থাকাটা রিস্ক মনে হচ্ছিলো, কারণ দু’জন একই রুমে থাকতাম। অবশেষে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এক বন্ধুর সাথে অন্য চাকরির খোঁজে বেরোতে গিয়ে মেয়াদ উত্তীর্ণ ভিসার কারণে সাবওয়ে রেল ষ্টেশনে পাতা পুলিশের জালে আটকা পড়ি।

 

‘পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, ইরাক ইত্যাদি দেশের লোকজন মারদাঙ্গা ধরণের। এসব দেশের কিছু লোকের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ কর্মকাণ্ডের কারণে ঠিক ওই সময়টাতেই সেদেশে বিদেশীদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছিলো এবং অপরাধ সংঘটনকারী ও অবৈধ অবস্থানকারীদের খুজে বেড় করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। আর এ কাজটি করা হচ্ছিলো শহরে বিদেশিদের চলাচলের প্রধান মাধ্যম সাবওয়ে রেল ষ্টেশনে তল্লাশির মাধ্যমে’।

 

পুলিশের হাতে ধরা পড়ার সময় একটু মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলাম। যে বন্ধুর সাথে বেরিয়েছিলাম সে বন্ধু যে কোম্পানিতে চাকরি করতো সে কোম্পনির নাম বলেছিলাম। কারণ সেই কোম্পানির ম্যানেজারের সাথে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো।‘কোরিয়াতে প্রবেশের পর প্রায় একমাস এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করার সময় প্রায় প্রতিদিনই তার সাথে আড্ডা জমতো’। সে জানতো যে আমি ব্যাবসায়িক কাজে গিয়েছি, তাই তার ওখানে চাকরি করিনি।

 

সেই কোম্পানির নাম বলাতে পুলিশ তাদের কাছে নিয়ে যায়। ম্যানেজার চেষ্টা করছিলো কিছু সালামী-টালামী দিয়ে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে রেখে পরে তার ওখানে চাকরি করাবে। কিন্তু শেষে কোনো আইনি ঝামেলায় পড়ে সেকারণে মালিক রাজী না হওয়ায় তা পারেনি এবং মালিক ফাঁস করে দেয়, আমি সেখানে চাকরি করি না।

 

পুলিশ আসলে চেয়েছিলো আমার কর্মস্থল থেকে ব্যাগ, কাপড়চোপড় সংগ্রহ করে তারপর ‘ইমিগ্রেশন প্রসেসিং সেন্টারে’ পাঠাতে। কিন্তু মিথ্যা তথ্য দিয়ে অন্য কোম্পানিতে নিয়ে যাওয়ায় আরেক বিপদে পড়ে গেলাম। অবশেষে শুধু পরিধেয় বস্ত্রে সিউল বিমান বন্দরের ‘ইমিগ্রেশন প্রসেসিং সেন্টারে’ চলে যেতে হলো। পরে অবশ্য কৌশলে ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে বাবুকে ফোন করলাম আমার কাপড়চোপড় পাঠানোর ব্যাবস্থা করতে। কারণ বাবুও অবৈধভাবে ছিলো।

 

পরেরদিন সকাল বেলায়ই কে বা কারা (সম্ভবতঃ কোম্পানির মালিক) আমার সব কাপড়চোপড় সহ ব্যাগ ও ব্রীফকেস একটা চিরকুটে আমার নাম ও দেশের নাম লিখে প্রসেসিং সেন্টারে দিয়ে যায়। সেন্টারের কর্মকর্তারা যখন তা আমার রুমে পৌছায় মনে মনে ভাবলাম, ‘এও কি সম্ভব’!

 

ইমিগ্রেশন প্রসেসিং সেন্টারে গিয়ে দেখি পূর্বে উল্লেখিত দেশের লোকজনে ভরা। ফ্লাইট সিডিউলের কারণে প্রসেসিং সেন্টারে কয়েকদিন থাকায় সেসব দেশের লোকদের কিছু কীর্তিকলাপ নজর কেড়েছিলো।

 

পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ইমিগ্রেশন প্রসেসিং সেন্টারে যখন যাই তখন সম্বল ছিলো মাস চলার মতো পকেটে থাকা বাংলাদেশি মুদ্রামানের মাত্র দশ বারো হাজার টাকা। নতুন কোম্পানিতে যে কয়দিন চাকরি করেছিলাম তার কোন বেতনও নিতে পারিনি। নিজের কাছে থাকা টাকা বা মুল্যবান কিছু থাকলে প্রসেসিং সেন্টারে জমা দেয়ার নিয়ম ছিলো। সেখান থেকে অবস্থানকারীর বিবিধ ব্যয় কেটে রেখে অবশিষ্ট টাকা ফেরত দিতো,- সেটা পরে জেনেছিলাম। অনেকের কাছেই বিমানের টিকেট থাকেনা সেটাও একটা কারণ। কিন্তু আমি ভীত ছিলাম অল্প কইয়েকটি টাকা জমা দিয়ে খালি হাত হওয়ার ভয়ে। প্রাত্যহিক খরচের টাকাই বা পাবো কোথায়। কিন্তু মুশকিল ছিলো টাকাগুলো লুকানোর’।

 

প্রসেসিং সেন্টারে টাকা জমা চাইলে যে বলছে টাকা নেই তাকেই জাঙ্গিয়া বাদে পরিধেয় সমস্ত বস্ত্র খুলে তল্লাশি করছিলো। এক্ষেত্রে দেখলাম বাংগালিদের বুদ্ধির কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হলো। টাকাগুলো মোজার মধ্যে রাখায় পূনঃপূনঃ তল্লাশি করেও তারা ধরতে পারেনি। আমার কাছে যে টাকা ছিলো বাংলাদেশি মুদ্রামানে তা দশ বারো হাজার টাকা হলেও কোরিয়ান কারেন্সিতে তা অনেক।

 

‘এ প্রসংগে অন্য একটি কথা মনে পড়ে গেলো। ওই সময়ে (১৯৯২) কোরিয়ান ২০ ওন সমান বাংলাদেশি এক টাকা। ১০,০০০ ওনের নোট আমাদের দেশের ৫০০ টাকার নোটের সমমানের। তদ্রুপ ৫০০০ এর সমমান ২৫০ টাকা, এক হাজারের সমমান ৫০ টাকা ইত্যাদি। কিন্তু ১০,০০০ ওনের নোটের পরিমান বাজারে কম ছিলো,  ৫০০০ ওন অর্থাৎ বাংলাদেশি মানের ২৫০ টাকার নোটই বেশি ছিলো। বাজারে নোটের পরিমান বেশি থাকায় মানুষের হাতেও তা প্রচুর থাকতো। আর সেটা মেয়েদের হাতেই বেশি ঘুরতো। কারণ কোরিয়াতে মেয়েরাই সাধারণতঃ কেনাকাটা বা বাজার করে থাকে যা আগেই বলেছি’।

 

‘বাম হাতের অনামিকা, মধ্যমা ও তর্জনী আঙ্গুলের ফাঁকে একটি বিশেষ কায়দায় ধরে ডান হাত দিয়ে খসখস শব্দে মেয়েরা যখন টাকা গুনতো, মনে হতো টাকা গোনাও একটা শিল্পকর্ম। আমাদের দেশের মেয়েরা এখনও তা দেখলে ম্যাজিক বলে মনে করবে।

 

কোরিয়াতে একটা শার্ট ইস্ত্রি করতে ওই সময়েই বাংলাদেশি মুদ্রামানের ৫০ টাকা লাগতো। চুল কাটানোর সময় বাংলাদেশি মানের ২৫০ টাকা অর্থাৎ ৫০০০ ওনের একটা নোট বেড় করে দিতে একটু ইতস্ততঃ এমনকি কষ্টই লাগতো। কারণ বাংলাদেশে তখন বড়জোর চার পাঁচ টাকায় চুল কাটানো যেতো। সেকারণেই বোধহয় সেলুনগুলোর সব কর্মী মেয়ে। নির্দিষ্ট এক ঘরের মধ্যে অল্প পরিশ্রমে অধিক আয়। ফলে হাইস্কুল ডিগ্রীধারী (আমাদের দেশের এইচএসসি্র সমমান) বা তার চেয়েও বেশি শিক্ষিত ও সুন্দরী মেয়েরা বেশিরভাগই সেলুনের কাজ বেছে নিতো। কারণ মিল-কারখানাতে তো পরিশ্রম বেশি। মিল কারখানার শ্রমিকদের চেয়ে আরামদায়ক অফিসিয়াল কাজের লোকদের আবার বেতন কম’।

 

আমার কাছেও ছোটবড় মিলিয়ে অনেকগুলো কোরিয়ান নোট ছিলো। অবশেষে নোটগুলি ভাগ করে দু’পায়ের মোজার মধ্যে ঢুকিয়ে অনেক কষ্টে জুতা পরলাম। তল্লাশির সময় যখন বলছিলো, একমাত্র জাঙ্গিয়া ছাড়া পরনে কিছুই থাকবেনা; লাইনে দাঁড় করিয়ে অন্যান্যদের চেক করার সময় এক ফাঁকে কৌশলে মোজা সমেত খুলে জুতার উপরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা কিছুই না পেয়ে ছেড়ে দিয়েছিলো।

 

যে কয়দিন প্রসেসিং সেন্টারে ছিলাম মোজার মধ্যেই টাকাগুলো বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিলাম। রুমে থাকা ইরানী, নেপালী মিলিয়ে ৭/৮ জন লোকের কেউ কোনোদিন তা টের পায়নি। কিন্তু সমস্যায় পড়েছিলাম বিমানে ওঠার দিন।

 

বিমানবন্দরে রওনা দেয়ার সময় ট্যক্সিক্যাব ভাড়া ও বিমানবন্দর এন্ট্রি ফি বাবদ আমার কাছে টাকা দাবী করলো। সেখানেও টাকা নেই বলায় আরেক দফা চেকিংএর ধকল সামলাতে হলো। এর আগে দফায় দফায় চেক করার সময় টাকা নেই বলায় তখন সামান্য ভাড়ার টাকা বেড় করতেও অবিশ্বাসী হওয়ার ভয়ে তা পারছিলাম না। কারণ পায়ের মোজার ভিতর থেকে টাকাগুলো বেড় করতে গেলে পেছনের সমস্ত চালাকিই ধরা পড়ে যেতো।

 

ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা বোর্ডিং পাশ নিয়ে যখন বিমানবন্দরের ভিতরে ঢুকে পড়লো তখন আর চালাকি ধরে রাখার সুযোগ ছিলো না। কারণ কোরিয়ান কারেন্সি নিয়ে বিমানে উঠে পড়লে তার আর কোন মূল্য থাকতো না।……….........(চলবে)

 

(১৯৯২ সালের ঘটনা : ২০১৪ সালের লেখা)

 

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url