কোলকাতার
শম্ভূনাথ হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে
পরের দিনই যথারীতি শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চেপে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। কিন্তু বিপত্তি
বাধে গেদে এসে।
‘অনেক চেষ্টা তদবির আর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর অবশেষে দীর্ঘ ৪৩ বছর পর পূনরায় ঢাকা-কোলকাতা
রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তবে ৪৩ বছর আগে ছিল ট্রেন ও ষ্টীমারে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাতায়াত।
বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মিত হওয়ার ফলে সরাসরি ট্রেন চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ভারতের
তৎকালিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জী ২০০৭ সালে ঢাকা সফরে এলে
বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। ট্রেনের নাম দেয়া হয় ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’।
২০০৮ সালের ১৪ই
এপ্রিল বাংলা পহেলা বৈশাখ থেকে ট্রেনটি নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলেও নানা অব্যবস্থাপনা,
নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট ষ্টেশনে পৌঁছতে ব্যর্থ হওয়া, দর্শনা ও গেদে ষ্টেশনে নির্ধারিত
সময়ের তিনগুন বেশি সময় লাগিয়ে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন কার্যাদি সম্পন্ন ইত্যাদি বিভিন্ন
কারণে তা যাত্রী আকর্ষণে ব্যর্থ হয়’।
‘কোলকাতা থেকে তিন ঘন্টায় ১১৯ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে গেদে এলেও ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’
এর কারণে গেদে থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে
চার ঘন্টা সময় লেগে গেল। দর্শনা ষ্টেশনে মৈত্রী এক্সপ্রেসের যাত্রীদের কাস্টম ও ইমিগ্রেশন
কাজ সম্পাদন করতে সময় লেগে যায় তিন ঘন্টা। তাদের জনবল স্বল্পতাই নাকি তার কারণ ছিলো।
আসলে কোরবানীর ঈদের ছুটিতে গিয়ে অনেকেই হয়তো সময়মত কাজে যোগদান করে নাই’।
‘ওদিকে গেদে ষ্টেশন কর্তৃপক্ষ বারবার খবর নিচ্ছে, তাদের ট্রেন সিডিউলে ব্যঘাত ঘটবে
বলে দর্শনা ষ্টেশন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছে। আর আমরা অপেক্ষায় আছি মৈত্রী ট্রেন পাস না
দিয়ে অন্যান্য যাত্রী’র ইমিগ্রেশন কাজ বন্ধ বিধায়। অবশেষে অবেলায় বাংলাদেশে প্রবেশ
করে কোনো ট্রেন না পেয়ে দর্শনায় রাত যাপন করতে হলো। ২০০৯ সালে আমার ফেসবুক আইডিও ছিলনা,
ফলে হোটেল রুমে নিশ্চুপ নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভোরে খুলনা মেইলে চেপে রাজবাড়ি পৌঁছি’।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, একবার নাহয় সখ করে ট্রেনে গেলাম ফেরত আসার সময় বেনাপোল
হয়ে বাসে আসলাম না কেনো। সচরাচর যারা বিদেশে যাতায়াত করেন তারা সহ অনেকেই হয়তো জানেন,
‘সিংগেল এন্ট্রি’ ভিসায় যে পথে যাওয়া সে পথেই আসতে হয়। ভিন্নপথে যেতে আসতে হলে ’ডাবল’
বা ’মাল্টিপল’ এন্ট্রি ভিসা সংগ্রহ করতে হয় যা আমার পূর্বে জানা ছিলোনা। পরবর্তীতে
ভারত নেপাল যাওয়ার সময় বিষয়টি বুঝেছিলাম। তবে উপযুক্ত কারণ ছাড়া ’ডাবল’ বা ’মাল্টিপল’
এন্ট্রি ভিসা সহজে পাওয়া যায়না’।
‘আমার গল্পের শিরোনামই হচ্ছে "গরীবের ভ্রমণ বিলাস"।
যারা সচরাচর বিদেশ সফর করেন তাদের কাছে এ গল্প পানসে লাগতে পারে।যারা নিজ দেশ ছাড়া অন্য কোনো
দেশে বেড়াতে যাননি তাদের কাছে একটু ভালো লাগলেও লাগতে পারে।তবে একটা কথা আমার মনে সবসময় নাড়া দেয়, সেটা হলো;
‘অনেকেই অনেক দেশ বা নিজ দেশের বিভিন্ন সৌন্দর্যমন্ডিত জায়গায় বেড়িয়েছেন।কিন্তু নিজের গ্রামের পাশের সবগ্রামে যাওয়া নাও হতে পারে’।
দীর্ঘ ৩৮ বছর পর ২০০৯ সালে একা কোলকাতা বেড়িয়ে এসে পরবর্তীতে স্ত্রীসহ ২০১০ সালে পূনরায়
রেলপথে কোলকাতা এবং ২০১১ সালে সড়কপথে কাঠমুন্ডু ও দার্জিলিং বেড়াতে যাই। সে অভিজ্ঞতা বলার আগে বন্ধুদেরকে একটু পিছনে নিয়ে যাবো।
‘শিশুকালে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে শুন্যে উড়ে বেড়াতাম। ঘুম ভাঙলে মনে হতো, সত্যি যদি এভাবে উড়ে বেড়ানো যেতো তাহলে কি মজাই না হতো। অনেকের কাছেই এমন স্বপ্নে ওড়ার গল্প শুনেছি। এ থেকেই ছোট্ট একটা আশা সবসময় বুকে লালন করতাম, ‘কবে একটু উড়াল দিতে পারবো’।
'১৯৮৪ সালে যশোর সেনানিবাসে ২১ নভেম্বর সশস্ত্রবাহিনী দিবস উপলক্ষে সমরাস্ত্র প্রদর্শনী দেখতে
গিয়ে প্রশিক্ষণ বিমানের ককপিটে বসে সেই স্পৃহা আরো বেড়ে যায়।যতদূর মনে পরে তখন ঢাকা যশোর রুটে ‘ওয়ানওয়ে’ বিমান ভাড়া ছিলো ৬২৫ টাকা। ভেবেছিলাম একদিন হলেও যশোর থেকে ঢাকা গিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করবো। কিন্তু পরবর্তীতে তা আর হয়ে ওঠেনি। শেষপর্যন্ত সুযোগটা আসে ১৯৯২ সালে এবং সেটা আভ্যন্তরীণ নয়, একেবারে আন্তরজাতিক রুটে’।
‘১৯৮৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে ব্যবসা করতে গিয়ে তেমন সুবিধা করতে না পেরে ১৯৯১
সালে নারায়নগঞ্জে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেই।ফার্মের ম্যানেজার হিসেবে ১৯৯২ সালে সুযোগ আসে ব্যবসায়িক কাজে দক্ষিণ কোরিয়া সফরের।আর এতেই পূরণ হয় সাধের আকাশে ওড়ার স্বপ্ন।দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ঘুরে এসে মনে হয়েছিল যারা বিমানে পা রাখেনি তারা আসলে মায়ের কোলেই
রয়ে গেছে'।
'আমরা যেমন কথায় কথায় বলি সবকিছু ‘আন্তর্জাতিকমানের’ হতে হবে।তেমনি বিদেশে না গেলে বহি:বিশ্বের কৃষ্টি কালচার অজানাই থেকে যায়।ফলে আধুনিক বিশ্বের একজন মানুষ হিসেবে অপূর্ণতা থেকে যায়।
‘আন্তর্জাতিকমানের’(!) হওয়া যায়না।একটা মানুষের সব দেশে যাওয়া সম্ভব হয়না।তবে হংকং এর মতো ’ট্র্যানজিট’ এয়ারপোর্টে গেলে এবং ‘দূর্ভাগ্যক্রমে’ সেখানে অবস্থানের সময়টা
বেশি হয়ে
গেলে বিশ্বের অনেক মানুষের সাক্ষাৎ মেলে। কিছু অভিজ্ঞতাও অর্জন হয়’।
‘১৯৯২ সালে বাংলাদেশ থেকে বেশকিছু লোক দক্ষিণ কোরিয়াতে কাজের সন্ধানে গিয়ে কেউ অবৈধ
কেউ সাময়িক ‘ওয়ার্ক পারমিট’ নিয়ে সে
দেশে অবস্থান করছিলো। তাই একা একা যাওয়ার সময় ঢাকা, হংকং এবং শিউল বিমানবন্দরে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়েছিলো
এবং কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতাও হয়েছিলো'।
'তখন ২০০০ ইউএস ডলার সাথে নিলে এবং তা পাসপোর্টে এনডোর্স করা থাকলে শিউল বিমানবন্দরে পোর্ট এন্ট্রি ভিসা দেয়ার নিয়ম ছিল(এখনকার নিয়ম স্টাডি করিনি)। অথচ আমার ব্যবসায়ী ভিসা থাকা সত্বেও ঢাকা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তারা কাগজপত্র পরীক্ষা
করার অজুহাতে কিছু সালামী আদায়ের জন্য বেশ কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখে। আমি কোনো পয়সা দিতে রাজি না হওয়ায় আমাকে যেতে দেবেনা বলে ভয়ভীতি দেখাচ্ছিল। কিন্তু আমার সোচ্চার ও দৃঢ় মনোবলের কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হয়।শেষ পর্যন্ত বিমান ছাড়ার আগ মূহুর্তে গিয়ে বিমানে উঠতে সক্ষম হই'। ........(চলবে)।
(২০০৯ সালের ঘটনা। লেখা ২০১৪ সালের)