সামনে বা পিছনে লোকের নিন্দা করা - মদ, জুয়া, জিনাহ্‌-ব্যাভিচারের চেয়েও ভয়াবহ পাপ!

সামনে বা পিছনে লোকের নিন্দা জিনাহ-বয়াভিচারের চেয়েও পাপ

 

সামনে বা পিছনে লোকের নিন্দা এমনই একটা পাপ, যে সম্পর্কে এমন পরিস্কার এবং নিশ্চিত করে জাহান্নামের হুঁশিয়ারী দেয়া হয়েছে, যা আমাদের অতি পরিচিত পাপ যেমন মদ, জুয়া, শুকরের মাংশ, এমনকি জেনা-ব্যাভিচারের ক্ষেত্রেও দেয়া হয়নি।

 

আমরা বেহেশতের দূয়ার খুলতে আর দোজখের আগুন নেভাতে,- ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব, কবিরা, সগিরা মাইক্রো, ন্যানো পাপ পূণ্যের বিবরণ খঁজতে পর্বত প্রমাণ হাদীস, তাফসির ফিকাহ, ফাজায়েলের কিতাব খুঁজি। কিন্তু কোরআনে যে কাজগুলোর জন্য একেবারে পরিস্কার ভাষায় জান্নাত বা জাহান্নামের হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে, শুধু সেই আয়াতগুলো অনুসরণ করলেও আমরা গাউসুল আযম বনে যাবো।

 

এই লেখায় যে আয়াত বা হাদীসগুল আলোচনা করবো তা বোঝার জন্য কোনো মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ভাষাবিদ ইত্যাদি কিছুই দরকার নাই। কোনো মুহাদ্দিস, মুফাসসির বা ভাষাবিদ এর অর্থ নিয়ে দ্বিমত করবেও না। যেকোনো অমুসলিমও বুঝতে পারবেন ইসলাম ধর্মের প্রধান প্রধান পাপ কি।

 

কিন্তু আমরা ন্যানো, মাইক্রো পাপ, পূণ্যের হিসাব মেলাতে গিয়ে পর্বত প্রমাণ পাপে চাপা পড়ে আছি। এই লেখাটি শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।

 

পাপ বা গোনাহ বলতে আমরা সাধারণত এমন কিছু কাজকে বুঝি যেসব কাজের জন্য আমাদেরকে পরকালে শাস্তি পেতে হবে। আর পূণ্য বলতে বুঝি এমন কিছু কাজ যার জন্য আমরা পরকালে পুরস্কৃত হবো।

 

এই পাপ-পূণ্য বা জান্নাত-জাহান্ননামের বর্ণনা যে কোনো ধর্মীয় আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়। কী কাজ করলে জাহান্নামের আগূ্নে পুড়তে হবে তা মোটামুটি আমাদের সবারই জানা।

 

বিভিন্ন ধর্মীয়  আলোচনায় নানান উদাহরহণ ঊপমা দিয়ে এই পাপ-পূণ্যের বিবরণ দেয়া হয়। কিন্তু কোরআনে বর্ণিত পাপ-পূণ্যের স্পষ্ট তালিকার সাথে আমাদের পরিচিত তালিকার খুব একটা সামঞ্জস্য নেই।

 

এই লেখায় কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনা অনুযায়ী যে পাপকাজের জন্য নিশ্চিতভাবে জাহান্নামে যেতে হবে তা আলোচনা করবো। কোরআনের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রাসংগিক হাদীসগুলোও উল্লেখ করবো। তাতে পরিস্কার বুঝবেন, আমরা হাদীস মানা নিয়ে ঝগড়া করলেও প্রকৃতপক্ষে ঝগড়ার হাদীসগুলোও মানি না।

 

কোরআনে আল্লাহ যতোবার জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ততোবারই বিশ্বাস ও সৎকর্মের পূর্বশর্ত দিয়েছেন। কিন্তু কোরআনের বিশ্বাস ও সৎকর্মের যে তালিকা আল্লাহ বর্ণনা করেছেন তার সাথে আমাদের সৎকর্মের তালিকার উল্লেখযোগ্য সামঞ্জস্য নাই।

 

“শুধু কোরআন মানলে ইসলামের আর কিচ্ছু থাকে না”, এমন অভিযোগ তুলে আমরা হাদীসকে কোরআনের মতোই অবশ্য পালনীয় বলছি। কিন্তু হাদীসেও বিশ্বাস ও সৎকর্মের যে বিবরণ আছে তার সাথেও আমাদের লোক দেখানো পূণ্যের তালিকার বিশেষ সম্পর্ক নাই।

 

একইভাবে যেসব পাপ কাজের জন্য আমাদেরকে দোজখে যেতে হবে, তার পরিস্কার তালিকা কোরআনে দেয়া আছে। হাদীসেও তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু আমরা যেসব কথিত পাপের বিরুদ্ধে জিহাদে নেমে ধর্মের নামে মানুষের জীবন দুর্বিসহ করে ফেলি, তার সাথে কোরআনে বর্ণিত শাস্তিযোগ্য পাপের তালিকার খুব একটা মিল নাই।

 

পোশাকের রীতি-রেওয়াজকে পাপ-পূণ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আসল পাপ-পূণ্য কিভাবে ধর্মীয় আলোচনার বাইরে চলে যায় তা এই লেখা থেকে পরিস্কার ধারণা পাবেন।

 

প্রাসংগিক হাদীসগুলো বোঝার উপর শাকের আঁটির মতোই কোরআনের বক্তব্যকে আরো জোরদার করে। এই আলোচনা থেকে কোরআন কতো সহজবোধ্য এবং বিষদভাবে বর্ণিত তার ধারণা পাবেন। কোরআনে যেসব পাপ-পূণ্যের স্পষ্ট বর্ণনা আছে তা বোঝার জন্য আমাদের হাদীস, ভাষা ব্যকরণ কোনো কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না। শুধু সেগুলো মানলেও আমরা সারা পৃথিবীর অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে উঠতে পারি। কিন্তু কোরআনের সাথে সম্পর্কহীন, কথিত ধর্মবিশ্বাস ও রীতি-রেওয়াজকে মাথা থেকে না সরালে আসল ধর্মের আলোচনাই ব্যর্থ হবে। একটা নতুন জুতায় পা ঢোকাতে হলে সবার আগে আপনার পূরান জুতাটি খুলতে হবে।

 

কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী ক্ষমার অযোগ্য সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য পাপকাজ আমরা এমন নির্বিকারভাবে করি, এসবকে আমরা পাপ তো দূরের কথা ধর্মের বিষয়ই মনে করি না। বরং এমন জঘন্য পাপকে আমরা খুব পূণ্যের কাজ মনে করি। অথচ কোরআনের যে কোনো অনুবাদ পড়ে একজন অমুসলিমও পরিস্কার বুঝবে যে, এই কাজগুলো ইসলামের সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এমন কাজের জন্য নিশ্চিতভাবে জাহান্নামে যেতে হবে।

 

‘সামনে বা পিছনে লোকের নিন্দা’ এমনই একটা পাপ যে সম্পর্কে এমন পরিস্কার এবং নিশ্চিত করে জাহান্নামের হুঁশিয়ারী দেয়া হয়েছে, যা আমাদের অতি পরিচিত পাপ যেমন; মদ, জুয়া, শুকরের মাংস, এমনকি জেনা-ব্যাভিচারের ক্ষেত্রেও দেয়া হয়নি।

 

পবিত্র কোরআনে “সুরা হুমাযাহ” নামে একটা সুরা আছে। এ সুরায় মাত্র ৯ টি আয়াত আছে, যার শেষ ৬ আয়াতে একদল মানুষের পাপের পরিণতি সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে;-

 

“কাল্লা-লাইউম্বাযান্না ফিল হুতামা” - কখনো না, এমন লোক অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়-(১০৪:৪)।

আল্লাহ নিজেই প্রশ্ন করছেন;

“ওয়ামাআওদরা-কা মাল হুতামা” - হুতামা কি তা কি তুমি জানো?(১০৪:৫)।

আবার আল্লাহ নিজেই জবাব দিচ্ছেন;

“না-রুল্লা-হিল মুকাদাহ” - ওটা আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত আগুন, যে আগুন কোনোদিন নিভবে না-(১০৪:৬)।

“আল্লাতী তাত্তালিউ আলাল আফইদা” - যা অপরাধীদের হৃদয়কে গ্রাস করবে-(১০৪:৭)।

 

তাদের শাস্তির আরো ভয়াবহ বর্ণনা আছে এ সুরায়। এই আয়াতগুলো থেকে এটা পরিস্কার যে, এক শ্রেণীর লোককে তাদের অপরাধের জন্য জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হবে। কিন্তু এই তওবা বা ক্ষমার অযোগ্য ভয়াবহ পাপী কারা?

 

এ পাপীষ্ঠদের সম্পর্কে সুরার শুরুর আয়াতে বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সুরার নামও তাদের নামে করা হয়েছে,- “সুরা হুমাজাহ”। এই হুমাজা মানে হচ্ছে “ব্যাক বাইটার” বা নিন্দুকে, ডিফেইমার বা মানহানীকর।

এরা এমন ব্যাক্তি যে সামনে বা পেছনে মানুষের নিন্দা করে, কুৎসা রটায় বা মানুষকে বিদ্রুপ করে, মানুষের সম্মনাহানী করে।

 

এই সুরার যে কোনো বাংলা বা ইংরেজি অনুবাদ কোনো অমুসলিমকে দিলেও তিনি মানুষের নিন্দা করা, কুৎসা রটানো বা মানুষকে বিদ্রুপ করার পরিণতি সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা দিতে পারবেন। কোনো মুহাদ্দিস বা মুফাসসির দরকার নেই। প্রত্যেকেই বুঝবে, নিন্দুকে কারা।

 

“ওয়াইলুলিলকুল্লি হুমাঝাতিল লুমাঝাহ” - দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে-(১০৪:১।

 

এ সুরায় নিন্দা বা সম্মানহানীর কথা বলা হয়েছে ‘লোকের’, - হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, আস্তিক, নাস্তিক, আওয়ামীলীগ, বিএনপি, কর্নেল, কন্সটেবল আলাদা করে বলা হয়নি।

যারা লোক বা মানুষকে বিদ্রুপ করে, কাউকে নিয়ে উপহাস করে, বা মানুষের নিন্দা করে, কুৎসা রটায়, সম্মানহানী করে, তাদের নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।

অথচ এ কাজগুলো আমরা নিঃশ্বাস নেয়ার মতো এতো স্বাভাবিকভাবে করি যে, এগুলোকে আমাদের কাছে ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু মনেই হয় না।

 

ফেসবুক, ইউটিউবে কোরআনের আলোচনায় কমেন্টে যতো অশ্লীল গালি-গালাজ দেখতে পাই তার বেশিরভাগই আপাতদৃষ্টিতে ধর্মপ্রাণ মুসলমান, মাদ্রাসা পড়ুয়া মওলানা।

ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারনে কাউকে ইহুদীর দালাল, খৃষ্টান মিশনারী এজেন্ট, এমনকি নাস্তিক বলে ফতোয়া দিচ্ছেন মদীনা আল-আযহারে পড়ুয়া শায়খরা।

কোরআনের কথা বললে নেকসুরতের ধোকাবাজ, আহলে কোরান ফেৎনা, এমন তকমা দিচ্ছেন সেলিব্রেটি শায়খরা। কিন্তু শায়খদের পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার বা কারো সম্মানহানী করতে দেখলে তার ভক্ত, অনুসারী এমনকি আমরাও অনেকে না বুঝে এসবকে পূণ্যের কাজ মনে করি।

 

ধর্মের নামে পূণ্যের আশায় বিভিন্ন নায়ক-নায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদদের ফেসবুক পেজে আমরা যেসব অশ্লীল, অস্রাব্য কমেন্ট করি, তার জন্য কোরআন অনুযায়ী আমরা নিশ্চিতভাবে হুতামায় নিক্ষিপ্ত হবো।

পক্ষান্তরে নাচ-গান বা নাটিক-সিনেমায় অভিনয় করার জন্য, হিজাব-নিকাব না পরার জন্য্য কাউকে দোজখে যেতে হবে, এটা প্রমাণ করতে মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ভাষাবিদদের টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।

 

মদ, জুয়া আল্লাহর অপছন্দ, এটা শয়তানের কাজ। কিন্তু মদ, জুয়াকে সরাসরি দোজখে যাওয়ার কারণ বলা হয়নি। শুকরের মাংস খাওয়া হারাম বলা হয়েছে, কিন্তু এরজন্য দোজখে যেতে হবে এমন হুঁশিয়ারী দেয়া হয়নি বরং  ক্ষুদার তাড়নায় জীবন রক্ষার্থে খাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

সব হারামের শাস্তি সমান নয়। ‘ইল্লিগ্যাল পার্কিংও ইল্লিগ্যাল, কিন্তু ইল্লিগ্যাল পার্কিংএর জন্য সামান্য আর্থিক জরিমানা করা হয়। জেল বা ফাঁসি হয় না।

 

একইভাবে যেসব হারামের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট শাস্তির উল্লেখ নেই, তার শাস্তি কি হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং আমরা সর্বাবস্থায় আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য আল্লাহর দয়া প্রার্থনা করি। কিন্তু যে কাজগুলোকে আল্লাহ বেহেশতে প্রবেশের পূর্বশর্ত বলেছেন বা যে কাজগুলোকে দোজখে যাওয়ার কারণ বলেছেন, সেগুলো বাদ দিয়ে হিজাব-নিকাবের মাফ কি হবে, তারাবীর নামাজের মাসালা নিয়ে পিএইচডি করতে মদীনা আল-আযহারে যাচ্ছেন আমাদের মেধাবী শায়খরা।

 

আমরা এক মুহূর্তের জন্য উপলব্ধি করিনা যে, “বডি সেমিং” একটা খারাপ কাজ। “বডি সেমিং” মানে কারো শারীরিক গঠন, গড়ন বা গায়ের রঙ নিয়ে বিদ্রুপ করা। অবমাননাকর বা কষ্টদায়ক মন্তব্য করা। এটা আমেরিকায় বেশ বড় রকমের অপরাধ। বড়বড় প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক চাকরি যায় বডি সেমিং-এর অভিযোগে।

 

আমাদের দেশে ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী’ এক সময় বিজ্ঞাপন দিতো, ‘গায়ের রঙ কালো হওয়ায় একটা মেয়ের চাকরি হয় না। এরপর ফেয়ার এন্ড লাভলী মেখে ফর্সা হওয়ার পর তার এয়ারলাইন্সে চাকরি হয়’। আমেরিকায় এ ধরণের বিজ্ঞাপন দিলে কোম্পানীর এড একাউন্ট ব্লক করে দেয়া হবে।

 

আমাদের সময়ে গ্রামেগঞ্জে কিংবা স্কুলন, মাদ্রসায় বন্ধুদের মাঝে একটা কুৎসিত নাম দেয়ার প্রচলন ছিলো(এখনও হয়তো আছে)। যেমন; লম্বু, বাটকু, মোটকি, ট্যাগরা, কাউল্লা, টাকলা, কালি, লেংড়া, ইত্যাদি। এছাড়া একটা সুন্দর নামকে বিকৃত করে উচ্চারণ করাতো নিয়মে পরিণত হয়েছিলো। যেমন; একজনের নাম সদরুল ইসলাম - তাকে ডাকা হতো ছাদু। একজনের নাম নবাব আলি – তাকে ডাকা ‘লবে’। আরেকজনে নাম মোহাম্মদুল্লাহ। তাকে প্রথমে মাদুল্লা, তারপর আরেক দফা সংক্ষেপ করে ডাকা হতো মাউদ্দ্যা। কোথায় মোহাম্মদুল্লাহ আর কোথায় মাউদ্যা!

 

সুরা হুজুরাতের ১১ নং আয়াতে বলা হয়েছে;-

 

“হে মুমিনগন, কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো মহিলা অপর কোনো মহিলাকেও যেন উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে।

তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করোনা এবং তোমরা একে অপরকে ‘মন্দ নামে’ ডেকো না; ইমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এধরণের আচরণ হতে নিবৃত নাহয় তারাই যালীম”

 

জুলুম শব্দটা কোরআনে আল্লাহ শিরকের সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। একই শব্দ ব্যবহার করেছেন, যারা মানুষকে বিদ্রুপাত্মক মন্দ নামে ডাকে, মানুষকে অযথা দোষারোপ করে, উপহাস করে।

পৃথিবীর কোনো সভ্যসমাজে একজন মানুষের শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতা বিদ্রূপ বা উপহাসের বিষয় হতে পারে তা অকল্পনীয় বিষয়।

 

‘এক মাদ্রসায় ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ার সময় এক ছাত্র গাড়িচাপা পড়ে। বাসের একটা চাকা তার পেটের উপর দিয়ে উঠে যায়। অলৌকিকভাবে সে বেঁচে গেলেও তার পেটের বেশকিছু অংশ কেটে ফেলেতে হয়। প্রায় এক বছর সে হাসপাতালে ছিলো। সুস্থ্য হয়ে ফিরে এসে আগের ক্লাসেই ভর্তি হয়। সবাই ঠাট্টা করে তার নাম দিলো, “পেট ফাটা শফিউল্লাহ”।

 

কাউকে কটাক্ষ করা যে এমন ভয়াবহ গোনাহ, তা না জানলেও কিশোর বয়সের মাদ্রাসা ছাত্ররা এটা জানতো, ‘এক ওয়াক্ত নামাজ ক্কাজা করলে ২ কোটি ৮৮ লক্ষ বছর দোজখের আগুনে পুড়তে হবে’। যদিও কোরআন, হাদীসের কোথাও এমন কথা লেখা নাই।

 

মাদ্রাসায় কারো চুল বড় অর্থাৎ চুল মুঠ করে ধরতে পারলে তার চুল কেটে দেয়া হয়। কিন্তু নবীজী(সাঃ) ঘাড়ের উপরে চুল ঝুলিয়ে রাখতেন, এমন একাধিক সহীহ বর্ণনা আছে। কিন্তু মাদ্রসার ছাত্ররা লম্বা চুল রাখাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে জানে। অথচ তা বড় দাড়ির মতোই নবীজী(সাঃ)-এর আরেকটি সুন্নাহ।

হজ্জ্বের সময় নবীজী মাথা মুন্ডন করেছেন। এছাড়া প্রায় সব সময় তাঁর চুল ঘাড়ের উপরে ঝুলানো থাকতো।

দাড়ি নিয়ে রণপ্রস্তুতি নেয়া শায়খরাও বড় চুল রাখেন না। কারণ বড় চুলের হাদীস তারা পড়েননি। কেনো পড়েননি? কারণ সে হাদীস পরীক্ষায় আসে না!

 

নিন্দা, বিদ্রুপ, বডি সেমিং যে কবিরা গোনাহ এটা পশ্চিমা বিশ্বের নন মুসলিম দেশের লোকেরা জানলেও আমরা জানিনা।

 

গীবত, নিন্দা, মিথ্যা অপবাদ, এমনকি আন্দাজ অনুমান, লোকমুখে শোনা কথার উপর ভিত্তি করে কারো সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করার পরিণতি সম্পর্কিত হাদীসগুলো পড়লেও নিশ্চিত হবেন যে, ইসলাম ধর্মের প্রধান আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিৎ সামনে বা পিছনে লোকের নিন্দা করা থেকে বেঁচে থাকা।

 

ইসলাম প্রতিষ্ঠার ইস্তেহারে প্রধান দাবি হওয়া উচিৎ, ‘গীবত ও পরনিন্দামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা’। 

 

বর্তমানে মদীনা, আল-আযহারের ডিগ্রীধারী বড় বড় শায়খরা শরীয়তের জটিল জটিল সমস্যার সমাধান দিচ্ছেন। দেশে ইসলামী সমাজ কায়েমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন! কিন্তু সে কথিত ইসলামী সমাজ উপহাস, বিদ্রুপ, পরচর্চা, গীবত, পরনিন্দামুক্ত সমাজ নয়। উত্তম কথা বলা, সুন্দর ভাষায় বিতর্ক করা, বিনয়, ভদ্রতা, শিষ্টাচার মুসলিম সমাজে তাদের কাছে অপরিহার্য নয়!

 

পিতা-মাতা, আত্মীস্বজন, অভাবী দরিদ্রদের দান করা, ছোটছোট বিষয়ে প্রতিবেশি সহকর্মীকে সাহায্য করাকে আমাদের কাছে সোস্যাল ওয়ার্ক হিসেবে বিবেচিত হলেও ধর্মচর্চা মনে হয়না। কিন্তু হাদীস, তাফসির, সকল মানদন্ডে একাজগুলো করা না করা শুধু পাপ-পূণ্য নয়, এগুলোই বেহেশত, দোজখ নির্ধারণ করবে। পক্ষান্তরে দাড়ি, বোরকা, আরবীয় জুব্বা, নূরানী পদ্ধতির আরবী শিক্ষা, রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে এক প্রকার ঠেকিয়ে চাঁদা তুলে পাড়ায় মহল্লায় প্রাসাদপম মসজিদ নির্মাণকে ইসলাম কায়েম নাম দিলেও, এগুলোতে পাপ-পূণ্য প্রমাণ করতে মাদানী, আযহারীর টাস্কফোর্স লাগবে।

 

কোরআন এবং কোরআনের সাথে সংগতিপূর্ণ হাদীস অনুযায়ীও এগুলোতে বিশেষ পূণ্য নাই। ফজিলত, ফাজায়েলের জাল কিচ্ছা বানিয়ে ভাষা ব্যকরণের মারপ্যাচে মাদানী, আযহারীর হুজুরদের মতামতের ভিত্তিতে এগুলকে ধর্মের প্রধান এজেন্ডায় পরিণত করা হয়েছে। এসব ‘অপশনাল’ বিষয়কে প্রায়োরিটি লিষ্ট থেকে বাদ না দিলে ধর্মের আসল কাজ করা হবে না।

 

প্রচলিত পোশাকী ধর্মাচারের কোনো বিশেষ তাৎপর্য সমাজ সংসারে নাই। এসব পোশাকী রীতি-রেওয়াজে মানুষের উল্লেখযোগ্য কিছু যায় আসে না। এ কাজগুলো করা এমন কঠিন কিছুও নয়।

 

পক্ষান্তরে এমন একজন মানুষের কথা কল্পনা করুন, যিনি সারাজীবনে কোনো মানুষকে একটা মন্দ কথা বলেনি, কারো নিন্দা করেনি, সহপাঠী, সহকর্মী, প্রতিবেশিকে বিদ্রুপ করেনি, কারো অমঙ্গল কামনা করেনি, কারো সম্পর্কে আন্দাজ, অনুমাননির্ভর বিদ্রুপ বা বিরুপ মন্তব্য করেনি, ফেসবুক, ইউটিউবে কাউকে উদ্দেশ্য করে বিরক্তিকর বা আপত্তিকর ভাষায় মন্তব্য করেনি, কারো বিরক্তি, দুর্ভোগ বা কষ্টের কারন হয়নি। এমন মানুষ কোটিতেও একজন পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

পেলেও এমন মানুষকে আমরা ভালো মানুষ বলি, কিন্তু ধার্মিক বলি না!

 

অনেক হিন্দু বা অমুসলিম সম্পর্কেও আমরা বলি বা বলতে শুনি, ‘তিনি খুব ভালো মানুষ; কারণ তিনি ভালো কাজ করেন, মন্দ কাজ করেন না’। এই ভালো কাজই হচ্ছে জান্নাতের চাবি। অর্থাৎ ভালো মানুষরাই জান্নাতে যাবে। আর মন্দ কাজ হচ্ছে দোজখের শিকল। খারাপ মানুষরা দোজখে যাবে।

 

৫ অয়াক্ত নামাজ পড়েন,- দাড়ি, টুপি, হিজাব, নিকাব সব মেনে চলা ধর্মপ্রাণ মানুষদের মধ্যে শতকরা কতোজন পাওয়া যাবে, যারা আলোচ্য দোষগুলো থেকে মুক্ত? শতকরা একভাগের চেয়েও কম!

 

আমরা যাদের ধার্মিকমানুষ বলি, তাদের সব সময় ভালোমানুষ বলি না। কিন্তু ধর্মের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালো মানুষ হওয়া।

মদ বা শুকরের মাংস বর্জন করা সহজ। কিন্তু গীবত, মানুষকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া, সামনে-পিছনে মানুষের নিন্দা করা, মানুষকে নিয়ে অবজ্ঞা, উপহাস করা, বডি সেমিং থেকে বিরত থাকা, ধর্মীয় মতপার্থক্য সত্বেও প্রতিপক্ষকে কাফের, মুরতাদ, নাস্তিক, ইহুদীর দালাল অপবাদ না দেয়া - পৃথিবীর অন্যতম কঠিন কাজ!

 

একজন ভালো মানুষ সকল সমাজের সম্পদ। একজন দয়ালু, হৃদয়বান মানুষকে অবোধ পশুপাখিও ছেড়ে যেতে চায় না। আবার দুষ্টপ্রকৃতির মানূষের ভয়ে পশুপাখিও ভীত সন্ত্রস্ত।

 

‘সারাদিন নামাজ পড়ে, সারাবছর রোজা রাখে, কিন্তু মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার করে; এমন একজন মহিলা সম্পর্কে নবীজী (সাঃ) বলেছেন যে, “সে জাহান্নামী। তার নামাজ রোজা তার কোনো কাজেই আসবে না”।

 

আমাদের নামাজ রোজা পোষাক-আশাকে কারো কিচ্ছু যায় আসেনা। কিন্তু আমাদের আচরণে যায় আসে। “সুরা ক্কলমের” ১০ থেকে ১৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন; নবীজী(সাঃ)কে নির্দেশ দিয়েছেন এই আয়াতগুলোতে যে;-

 

“আপনি মিথ্যাচারীদের অনুসরণ করবেন না। আর যারা পিছনে নিন্দাকারী, যে একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগিয়ে বেড়ায়, যে ভালোকাজে বাধাদান করে, যে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে সমৃদ্ধশালী হওয়ায় মানুষের সাথে রূঢ় আচরণ করে”-(৬৮:১০-১৪)।

 

নবীজী(সাঃ) নিশ্চই আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে এসব নিকৃষ্ট চরিত্রের মানুষদের এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু আমরা এখন এমন কুৎসিত চরিত্র নিয়ে নিজেদের নবীর উম্মত দাবি করি।

 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলেছেন;-

 

“হে মু’মিনগণ! তোমরা বহুবিধ অনুমান হতে দূরে থাক; কারণ অনুমান কোন কোন ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করনা এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করনা। তোমাদের মধ্যে কি কেহ তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে চায়? বস্তুতঃ তোমরাতো এটাকে ঘৃণাই মনে কর”-(৪৯:১৩)।

অনুমান করা, অর্থাৎ নেতিবাচক অনুমান করা পাপ।

 

বিনোদনমূলক মিডিয়ায় কাজ করে, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করে, ইউরোপ আমেরিকায় বসবাস করে,- এমন মানুষদের চরিত্র সম্পর্কে আমরা নেতিবাচক কিছু ধারণা করে নেই। কোরআন অনুযায়ী এমন ধারণা করাই পাপ। সে ধারণার ভিত্তিতে বিরুপ মন্তব্য করা আরো ভয়াবহ পাপ। কোরআনে কারো গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করা, এবং তার দোষ প্রচার করাকে মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। কোরআনের এ আয়াতে আল্লাহ যে উপমা দিয়েছেন, তা থেকেই পরিস্কার যে, আল্লাহর নিকট এ কাজগুলি কেমন ঘৃণিত।

 

পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য মানুষটিও সে তার মৃত ভাইয়ের মাংস খায়,- এমনটা আমরা কল্পনাও করতে পারিনা। কিন্তু সমমানের পাপ বা অপরাধ আমরা মিনিটে মিনিটে করছি। এর কারণ আমাদের ধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠানে এগুলো বিবিধের তালিকায় থাকে, যা সময় স্বল্পতার কারণে আলোচনা করা হয়ে ওঠেনা। আলোচনার বেশিরভাগ টপিক থাকে;

নবী নূরের তৈরি না মাটির তৈরি, মিলাদ, কিয়াম, মৃতের জন্য খাওয়ানো জায়েজ কিনা- এসব জরুরী ‘জনগুরুত্বপূর্ণ’ আলোচনায় এবং ঝগড়ায় সময় চলে যায়।

 

আমাদের লেখার বিষয়ে অশালীন কমেন্টের প্রধান বিষয়বস্তু ‘কোরআন-কেন্দ্রিক’ কথা বলা। কোরআন মানলে উপরে বর্ণিত বেশিরভাগ কিছুই পরচিত ধর্মের আলোচ্যসূচী থেকে বাদ পড়ে, তাই হাদীস লাগবে।

 

গায়ক, নায়ক, শিল্পী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ সবার পেজে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা যেসব পড়ার অযোগ্য কমেন্ট করেন তা কোন হাদীস অনুযায়ী করেন?

 

চলুন একটু দেখে নেই আমাদের হাদীস মানার নমূনাঃ

 

“হযরত আবু হুরাইরা(রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল(সাঃ) এরশাদ করেছেন; “তোমরা আন্দাজ অনুমান থেকে বেঁচে থাকো, কেননা অনুমান করে কথা বলা সবচেয়ে বড় মিথ্যা”- (সহীহ আল-বুখারী তাওহিদ পাবলিকেশন হাদিস নং ৬০৬৬)।

 

পবিত্র কোরআনের প্রথম পাতায় আল্লাহ বলেছেন;-

 

“আর তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাবাদী”-(২:১০)।

 

সুতরাং মিথ্যা বলা শুধু হারাম, বা কবিরা গোনাহ নয়, তা কষ্টদায়ক শাস্তির কারণ। আর নবীজী(সাঃ)-এর হাদীস অনুযায়ী মিথ্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় মিথ্যা হচ্ছে, “অনুমান করে কথা বলা”। এ আন্দাজ, অনুমানের উপর আমরা মানুষ সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করি।

 

একবার রাসুল(সাঃ) সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা কি জানো গীবত কাকে বলে?

‘গীবত হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কোনো কথা বলা যা শুনলে সে অপছন্দ করবে’।

সাহাবারা জানতে চাইলেন, “হে আল্লাহর রাসুল, যদি সত্যিই তারমধ্যে সে দোষ থাকে, তাহলেও কি গীবত হবে”?

রাসুল(সাঃ) বললেন, “যদি সত্যি তারমধ্যে সে দোষ থাকে তবে তা গীবত হবে। আর যদি তারমধ্যে সে দোষ না থাকে তবে তা মিথ্যা অপবাদ দেয়া হবে, যা গীবত থেকেও মারাত্মক গোনাহ”-(মুসলিম-২৫৯৮; আবু দাউদ-৪৮৭৪; তিরমিজী-১৯৩৪)।

 

কোরআনে গীবত ও মিথ্যচার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার মতো অকল্পনীয় জঘন্য কাজ। আর হাদীসে গীবত ও মিথ্যাচারের আরো বিষদ ব্যাখা আছে।

 

“কোনো মানুষের সম্মানহানীর পরিণতি সম্পর্কে নবীজী(সাঃ০ বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানী বা অন্য কোনো জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই বা দুনিয়াতে থাকতেই তার নিকট ক্ষমা চেয়ে নেয়। ঐদিন আসার পূর্বে, যেদিন তার কোনো দিনার বা দেরহাম থাকবে না। যেদিন তার কোনো নেক আমল থাকলে সেখান থেকে জুলুমের সমপরিমান তার থেকে কর্তন করে নেয়া হবে। আর তার কোনো নেক আমল না থাকলে জুলুমের সমপরিমান কিছু গোনাহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে”-(বুখারী হাদিস নং ২২৮৭)।

 

এ হাদীস অনুযায়ী নায়িকা, গায়িকা বেহেশতে যাবে শুধু তাদের পেজে করা অশ্লীল কমেন্টের কারণে। আর যারা পূণ্যের আশায় এমন নিকৃষ্ট কমেন্ট করেন, তারা এসব কমেন্টের কারণেই দোজখে যাবে।

 

মডেল বা নায়িকারা যেসব পোশাক পরেন তা যৌন উত্তেজক; এটা তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ। কিন্তু এ কারণে আমরা তাদের পেজে বা তাদের সম্পর্কে অশ্লীল নোংড়া কমেন্ট করাকে জায়েজ মনে করি। কিন্তু হাদীস অনুযায়ী যৌন উত্তেজক পোষাক পরা নয়, গীবত বা নিন্দার গোনাহ অবৈধ যৌনাচারের চেয়েও কঠিন।

 

উল্লেখ্য, যৌন উত্তেজক পোশাক বলে কিছু নেই। একজন মানুষ চোখ বন্ধ করেও উত্তেজিত হতে পারে। যারা অন্ধ তারাও উত্তেজিত হয়। কাউকে নির্জন দ্বীপে রেখে এলেও তিনি উত্তেজিত হতে পারবেন। একজন পুরুষকে দেখেও একজন নারী বা একজন সমকামী পুরুষ উত্তেজিত হতে পারে। কারো উত্তেজনা রোধ করার জন্য নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে এমন কোনো বিধান কোরআন, হাদীসে নাই। আছে কোরআন হাদীসের ‘মহাবৈজ্ঞানিক’ ব্যাখ্যায়।

 

শুধু গীবত বা পরনিন্দা সম্পর্কে হাদীসের বর্ণনা শুনলে যে কেউ বলে দিতে পারবে যে, গীবত বা পরনিন্দা কতো ভয়ংকর পাপ। গীবত বা পরনিন্দা হচ্ছে, কারো সম্পর্কে এমন কথা বলা যা শুনলে সে কষ্ট পায়। রাসুল(সাঃ) বলেছেন যে, ‘গীবত - জেনা বা অবৈধ যৌনাচারের চেয়েও ঘৃণ্য ও জঘন্য গোনাহ’।

 

ব্যাভিচারী নারী-পুরুষকে পাথর মেরে হত্যা করার বিধান কোরআনে নাই। কিন্তু কারো নামে ব্যাভিচারের মিথ্যা বা অনুমানুনির্ভর অপবাদ দিলে তার শাস্তি ৮০ বেত্রাঘাত। যে কোনো বংগানুবাদ পড়লেই বুঝবেন।

 

“আর যারা সচ্চরিত্রা নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারপর তারা ৪ জন স্বাক্ষী আনতে ব্যর্থ হয় তাদের তোমরা ৮০ টি বেত্রাঘাত করো এবং তোমরা কখনো তাদের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করবে না। এরাই ফাসেক বা পাপিষ্ঠ”-(২৪:৪)।

ব্যাভিচারী নারী-পুরুষকে ১০০ বেত্রাঘাতের বিধান আছে “সুরা নূর”এ। কিন্তু তার জন্য ৪ জন প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষী লাগবে।

 

৪ জন মানুষের সামনে যে ব্যাভিচার করে তাকে অবশ্যই জুতাপেটা করা দরকার। তবে “সুরা নূর”এ কাউকে ব্যাভিচারের অপবাদ দেয়াকে গুরুতর পাপ বলা হয়েছে। ৪ জন স্বাক্ষী না থাকলে বাকি ৩ জন স্বাক্ষীও অপবাদের অভিযোগে দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তি পাবে।

 

“সুরা নূর”এর আলোচনায় ব্যাভিচারের চেয়েও ব্যাভিচারের অপবাদ এবং প্রচারের শাস্তির কঠোরতা বেশ স্পষ্ট।

 

“যারা এই অপবাদ রচনা করেছে তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে তাদের কৃত পাপের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এই ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে তার জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি”-(২৪:১১)।

 

“এ কথা শোনার পর মুমীন পুরুষ বা নারীগণ কেনো নিজেদের লোক সম্পর্কে উত্তম ধারণা করেনি এবং বলেনি; এটাতো সুস্পষ্ট অপবাদ”-(২৪:১২)।

 

“যখন তোমরা লোকমুখে এটা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিলোনা এবং তোমরা একে তুচ্ছ গণ্য করছিলে, যদিও আল্লাহর নিকট ছিলো এটা গুরুতর বিষয়”-(২৪:১৫)।

 

“এবং তোমরা যখন এটা শ্রবণ করলে তখন কেন বললেনাঃ এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদের উচিৎ নয়; আল্লাহ পবিত্র, মহান! এটাতো এক গুরুতর অপবাদ”-(২৪:১৬)।

 

“আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেনঃ তোমরা যদি মু’মিন হও তাহলে কখনও অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করনা”-(২৪:১৭)।

 

“যারা সাধ্বী, সরলমনা ও বিশ্বাসী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি”-(২৪:২৩)।

 

 

আমাদের পরিচিত ধর্মচর্চায় জেনা বা অবৈধ যোনাচার সবচেয়ে জঘন্য পাপ বলে বিবেচিত! পরপুরুষের সাথে কথা বললে মুখের জিনাহ! পরস্ত্রীর দিকে তাকালে চোখের জিনাহ! - এসব কোরআন হাদীস বহির্ভুত মতামতের ভিত্তিতে মেয়েদের ঘরবন্দি করে রাখা আমরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রধান এজেন্ডা বানিয়েছি।

 

কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের মুরগি আর ছেলেদের শিয়ালের সাথে তুলনা করে কথিত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের কুরুচিপুর্ণ মন্তব্য আমরা সোস্যাল মিডিয়ায় দেখি। কিন্তু কেউ জিনাহ করলে তার যে পরিমাণ গোনাহ হবে, তারচেয়ে বেশি গোনাহ হবে যদি অন্য কারো দোষত্রুটি উল্লেখ করে তার সম্মানহানী করে।

 

রাসুল(সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি জিনাহ করে অতঃপর সে তওবা করে ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু গীবতকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত যার গীবত করা হয়েছে, সে ক্ষমা না করে”।

 

হযরত আনাস(রাঃ) থেকে অপর এক বর্ণনায় বলা আছে, রাসুল(সাঃ) বলেছেন; “জিনাহকারী তওবা করে, কিন্তু গীবতকারীর তওবা নাই”।

 

একবার চিন্তা করে দেখুন গীবত তথা কথায় বা ইশারা ইংগিতে অথবা অন্য কোনো উপায়ে অন্যের অনুপস্থিতিতে তার দৈহিক বা চারিত্রিক দোষত্রুটি, ‘যদিও তা সত্য’ - আলোচনা করে বা আলোচনা করা হয় যা শুনলে সে মনে ব্যথা পেতে পাবে; এই গীবত এমন ভয়াবহ পাপ যে তার তওবাও গ্রহণযোগ্য নয়।

 

গীবতকে জিনাহর চেয়েও বড় পাপ বলা হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমান যারা জিনাহ তো দূরের কথা, পরপুরুষ বা পরস্ত্রীর সংস্পর্শে আসতেও নারাজ। তারা অবলিলায় গীবত, মিথ্যাচার, অনুমাননির্ভর কথাবার্তা বলে বেড়ায়।

 

আমরা নিজের অবচেতনে গীবত বা মিথ্যাচারের মতো জঘন্যতম গোনাহয় ডুবে আছি। কট্টর মুসলিম সমাজেও এমন ব্যাক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন, যিনি এই তওবার অযোগ্য গোনাহ থেকে মুক্ত। এর অন্যতম প্রধান কারণ, আমরা গীবত ও অনুমাননির্ভর কথা বলাকে পাপকাজ বলে মনে করি না। এটা যে মারাত্মক গোনাহ এবং এর পরিণাম যে অত্যন্ত ভয়াবহ সে উপলব্ধিও আমাদের অন্তর থেকে মুছে গেছে। আমরা গীবত বা নিন্দা করতে সামান্যতম দিধাও করি না।

 

“যে ব্যাক্তি কোনো মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ ঢেকে রাখবেন”।

 

নিজের গোপন পাপ প্রচার করা বা প্রকাশ করাও গুরুতর পাপ। নবীজী(সাঃ) বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে সবাইকে ক্ষমা করা হবে শুধু মুজাহিরিন ব্যাতীত”। মুজাহিরিন হচ্ছে যারা নিজেদের পাপ জাহির করে, প্রকাশ বা প্রচার করে।

 

‘বডি সেমিং’ বা কারো শারীরিক গঠন সম্পর্কে তার সামনে বা পিছনে অবমাননাকর মন্তব্য করা বা ইংগিত করা, ইসলামে জিনা-ব্যাভিচার, মদ, জুয়া বা শুকরের মাংস খাওয়ার চেয়েও বড় পাপ।

 

হযরত আয়েশা(রাঃ) বলেন, আমি রাসুল(সাঃ)কে বললাম, আপনাকে সাফিয়া সম্পর্কে এতোটুকু বলাই যথেষ্ট যে, সাফিয়া এরকম, অর্থাৎ তিনি একটু বেঁটে। একথা শুনে রাসুল(সাঃ) বললেন, “তোমার এ কথাকে যদি সমুদ্রের সাথে মিশ্রিত করে দেয়া হয় তবে তা সমুদ্রের রঙ পরিবর্তণ করে দেবে”।

 

নবীজী(সাঃ)এর স্ত্রী সাফিয়া(রাঃ) একটু বেঁটে ছিলেন। হযরত আয়েশা(রাঃ) এ কথাটি রাসুল(সাঃ)এর কাছে ইংগিত করে বলেছেন। রাসুল(সাঃ) হযরত আয়েশা(রাঃ)র এ বক্তব্যকে সমুদ্রের পানির রঙ পরিবর্তণকারী দুষিত আবর্জনার সাথে তুলনা করেছেন। একবার কল্পনা করুন, কয় ট্রিলিয়ন টন আবর্জনা সমুদ্রে ফেললে সমুদ্রের পানির রঙ বদলাবে!

 

একজন বেঁটে মানুষকে তুচ্ছ করে বেঁটে বলা বা ইংগিতপূর্ণভাবে অসম্মান করা ইসলামে এমন নিকৃষ্ট গোনাহ। কারো দোষত্রুটি প্রচার বা প্রকাশ করা তো দূরের কথা নবীজী(সাঃ) তা অনুসন্ধান করা থেকেও বিরত থাকাকে ঈমানের অংশ বলে উল্লেখ করেছেন।

 

“হে মানবসকল, তোমারা শুধুমাত্র মুখে ইমান এনেছো, ইমান তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি। তোমরা মুসলমানদের গীবত করোনা এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করোনা। কেননা, যে ব্যক্তি মুসলমানদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আল্লাহ যার দোষ অনুসন্ধান করেন তাকে স্বগৃহেও লাঞ্ছিত করেন”(আবু দাউদ ৪৮৮০)।

 

নবীজী(সাঃ)এর হাদীস অনুযায়ী যে আড্ডায় গীবত বা পরনিন্দা হয়, সেখানে চুপচাপ শোনাও গীবতের সমপর্যায়ের অপরাধ।

 

রাসুল(সাঃ) বলেছেন, “যখন তোমার উপস্থিতিতে কারো গীবত করা হয়, তখন তুমি তার প্রশংসা শুরু করে দেবে। অর্থাৎ যার গীবত করা হয় তার প্রশংসা শুরু করে দেবে। তার ভালো দিকগুলো তুলে ধরবে। সম্ভব হলে গীবত বন্ধ করার চেষ্টা করবে অন্যথায় সে মজলিশ বর্জন করবে। কেননা, চুপ থাকলে তুমিও গীবতকারী বলে গন্য হবে”।

 

গীবত, পরনিন্দা, অনুমাননির্ভর মিথ্যা অপবাদ দেয়া, বডি সেমিং, কাউকে বিদ্রুপ বা উপহাস করা, কার সাথে রূঢ় আচরণ করার পরিণাম যে নিশ্চিত জাহান্নাম তা কোরআনের বর্ণনা থেকেই পরিস্কার। হাদীস, ফিকাহ, ভাষা ব্যকরণের জটিল জিজ্ঞাসার কোনো প্রয়োজন নাই। এ সংক্রান্ত হাদীসগুলো অনেকটা বোঝার উপর শাকের আঁটির মতোই, যা কোরানের বক্তব্যকেই আরো জোরদার করে।

 

যুগে যুগে দেশে দেশে যারা ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা তাদের অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট দিয়েই মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। কিন্তু আমরা তাদের পোষাক-আশাক, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকেই অনুসরণ করছি, যেসবের সাথে আমাদের ধর্্‌ সমাজসংস্কৃতি, জীবনন-জীবিকার কোনো সম্পর্ক বা সামঞ্জস্যতাও নেই।

 

মানুষ যাকে ভক্তি করে, স্বাভাবিকভাবেই তাকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে। তারকা খেলোয়াড় বা রাজনৈতিক নেতাদের বেলায়ও তা প্রযোজ্য। কিন্তু এসব পোশাকি রীতি-রেওয়াজ, প্রথা, পার্বনকে- ফরজ, হারাম বানাতে যুগে যুগে অসংখ্য জাল গল্প বানানো হয়েছে। কারন পোষাক বদলানো যতো সহজ, চরিত্র বদলানো ততোই কঠিন।

 

পোশাকী ফজিলতের জাল গল্প-গুজব শত বছরের পুরনো আগাছার মতো আমাদের মন মগজে এমনভাবে শিকড় গেড়েছে যে, সেখানে প্রকৃত ধর্মের আবাদ করা প্রায় অসম্ভব। অনেক বছরের অনাবাদী জমিতে ফসল ফলাতে হলে সবার আগে সে জমির আগাছা পরিস্কার করতে হবে, তা চাষাবাদের উপযোগী করতে হবে। নইলে জমিতে যতো সার, সেচই দেয়া হোক না কেনো, আগাছাই বাড়বে।

 

আমাদের মন মগজ থেকে ধর্মের আগাছা উপড়ে ফেলতে না পারলে কোরআন, হাদীস, ফিকাহ, ফাজায়েলে আমল, যাই পড়ি, বেহেশত দোযখের যতো ওয়াজই শুনি, তাতে আগাছার শিকড়ই শক্ত হবে।

 

বেহেশত দোযখের আলোচনার পর আমাদেরকে সিলেবাস বহির্ভুত কিছু কর্মসূচী ধরিয়ে দেয়া হয়, যার সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্কই নাই। এই সিলেবাস বহির্ভূত ধর্মীয় কর্মসূচীকে প্রাধান্য দিতে ফজিলত, ফাজায়েলের অসংখ্য জাল গল্প বানিয়ে সেসবকে হাদীস নাম দিয়ে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।

 

“মহিলারা পর্দা না করলে অর্থাৎ আপাদমস্তক ঢেকে না রাখলে তার ভাই, পিতা, বড় ছেলে এবং স্বামী দোযখে যাবে। মহিলাদের চুল দেখা গেলে সে চুল সাপ হয়ে কামড়াবে”- এমন কথা আমাদের সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও এধরণের আজগুবি কথা কোরআনেও নাই, কোনো প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থেও নাই।

 

কারো সাথে তর্কের দরকার নাই, আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, মহিলারা আপাদমস্তক ঢেকে না রাখলে বা পুরুষ-মহিলা একসাথে লেখাপড়া বা চাকরি করলে তারা জাহান্নামে যাবে একথাটা কোরআনের কোন আয়াতে আছে? কোন হাদীসের কিতাবে আছে? যে আয়াত বা হাদীস পেশ করবে তা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলেই দেখবেন তার সাথে বেহেশত দোযখ তো বহুদূর, পাপ পূণ্যেরই সম্পর্ক নাই। কিন্তু মুফতি, মুহাদ্দিস, আযহারী, মাদানী, টাস্কফোর্স গঠন করে এসবকে ধর্মের প্রধান অংশ বানানোয় আমাদের সমাজে হিজাব, নিকাব পরা পর্দাদানসীন অসংখ্য নারী পাবেন যারা গীবত, পরচর্চা, পরনিন্দা, অনুমাননির্ভর মিথ্যা, অপবাদ দেয়া, বডি সেমিং, চোগলখোরী, অর্থহীন আলাপের মতো ক্ষমার অযোগ্য কঠিন পাপে ডুবে থাকে।

 

খোঁজ নিলে দেখবেন আমাদের পরিচিত প্রতিটা পরিবারে, আমাদের নিজেদের সংসারে, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যতো সমস্যা, ঝগড়া-বিবাদ, এর কারণ বেহুদা কথা।

 

কথায় কথায় কারো সম্পর্কে একটা বাজে কথা বলা, একজনের কথা অসাবধাণতাবশতঃ বা কথা প্রসংগে আরেকজনের সামনে বলে ফেলা, কারো নামে কুৎসা রটানো, কারো বদনাম করা, এগুলোই প্রতিটা ঘরে ঘরে অশান্তির কারণ।

টাকা পয়সা কোনোকিছুর অভাব নাই তবুও প্রতিটা ঘরে ঘরে অশান্তির কারণ আমাদের বদভ্যাস, কথায় আচরণে অসাবধানতা। আমরা বুঝতেও পারিনা যে, আমরা যা বলছি তা গীবত, মিথ্যাচার বা বডি সেমিং।

 

আমরা অনেক সময় সাহসী, স্পষ্টভাষী, ইত্যাদি বিশেষণের আড়ালে এই তওবার অযোগ্য পাপগুলোকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করি। কোনো জুলুম, অবিচারের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিবাদ অবশ্যই সাহস ও সত্যনিষ্ঠতা।

আবার কোনো ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে বা ক্ষমতাধর কারো তোষামদে কোনো পূণ্য নাই। এ দুয়ের বাইরে আমাদের চারপাশে এমন অসংখ্য মানুষ আছে যাদের টাকা পয়সার প্রয়োজন নাই। তাদের সবচেয়ে বেশি দরকার কিছু ভালো কথা।

 

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্র সৈকতেও বহু মানুষ বিষন্ন দিন পার করছে। একজন ভালো বন্ধু, ভালো কথা বলার মানুষ তার কাছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপ বা ব্যক্তিগত বিমানের চেয়েও দামি। মানুষকে ভাল কথা বলা উত্তম দান। বিনয়, ভদ্রতা, সুন্দর আচরণ, উত্তম কথায় পাথরেও ফুল ফোটে। সম্মান, ভালোবাসা ও প্রশংসায় যে কোনো মানুষকে জয় করা যায়।

 

ধর্মের আসল যে উদ্দেশ্য, আত্মসুদ্ধি, সৎকর্ম, উত্তম আচরণ, তা আমাদের ধর্মচর্চার তালিকা থেকেই বাদ পড়েছে। ধর্মের আসল উদ্দেশ্য ভালো মানুষ হওয়া, নিজেকে পরিশুদ্ধ করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন;

 

“শপথ মানুষের এবং তাঁর, যিনি তাকে সুঠাম করেছেন।

অতঃপর তাকে তার অসৎ কাজ ও তার সৎ কার্জের জ্ঞান দান করেছেন,

সে’ই সফলকাম হবে যে নিজেকে পবিত্র করবে।

এবং সে’ই ব্যর্থ মনোরথ হবে যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে”-(৯১:৭-১০)।

 

আমরা আমাদের সন্তানদের ভালো স্কুলে পাঠাই যাতে তারা ভালো মানুষ হতে পারে। কম বেতনেও মানুষ এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চায়, যেখানে কাজের পরিবেশ ভালো। এ ভালো স্কুল, ভালো প্রতিবেশি বা ভালো কাজের পরিবেশ মানে যেখানকার মানুষগুলো ভালো। 

 

আমাদের ছোটবেলায় স্কুল পালানোর জন্য আমাদের কতো প্রচেষ্টা ছিলো। কিন্তু সভ্যদেশে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাচ্চারা মাঝরাতে উঠে বসে থাকে। স্কুলে তাদের বডি সেমিং, বুলিং-এর শিকার হতে হয় না।

 

আমাদের ধর্মগুরুরা যদি ভালো মানুষ হওয়ার, মানুষের সাথে ভালো আচরণের দীক্ষা দিতো, নাস্তিকরাও তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠাতো!

 

জিহবার মধ্যভাগ, তাল বরাবর উপরে তালুর সংগে লাগাইয়া ‘জিন’ ‘শীন’ ‘ইয়া’ উচ্চারণের প্রশিক্ষণ দেয়ার চেয়েও অনেক বেশি জরুরী এই জিহবা দিয়ে কোরআন, হাদীসের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশুদ্ধ কথা বলার প্রশিক্ষণ দেয়া। যাতে মনের ভুলেও, মুখ ফসকেও একটা খারাপ কথা না বের হয়।

 

আমরা যখন মৃত্যু চিন্তা করি, পরকালের কথা ভাবি, তখন আমরা দাড়ি বড় করা, মৌছ ছোট করা, টুপি, পাঞ্জাবী, হিজাব, নিকাব আর ফজিলত ফাজায়েলের বিভিন্ন দোয়া পড়ে মসজিদ, মক্তবে দান করে পূণ্যের পাল্লা ভারি করার চেষ্টা করি। কিন্তু পরকালের প্রস্তুতিতে সবকিছুর শুরুতে থাকা উচিৎ যে, আজ থেকে আমি কারো সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা করবো না। ধারণাপ্রসুত মন্তব্য করবোনা, কারো দোষত্রুটি অনুসন্ধান করবো না, কাউকে বিদ্রুপ করবো না, কারো নিন্দা করবো না, কথায়, আচরণে কাউকে কষ্ট দেবো না, প্রয়োজনের অতরিক্ত সম্পদ জমিয়ে না রেখে তা কোরান নির্দেশিত খাত, পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্থ মানুষদেরকে দান করবো। প্রতিদিনের প্রার্থণায় আল্লাহর কাছে আমাদের চাওয়া হওয়া উচিৎ আমরা যেনো ভালো মানুষ হতে পারি। অহংকার, লোভ-লালসা, হিংসা, বিদ্রুপমুক্ত পরিশুদ্ধ মানুষ হতে পারি।

 

 (সজল রোশনের ভিডিও অবলম্বনে)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url