গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-৪)
গেদে ষ্টেশনের
অদূরেই বিএসএফ চেকপোষ্ট। ইমিগ্রেশন অফিস ষ্টেশনের একদম সাথে। পরন্ত বেলায় বিএসএফ
চেকপোষ্টে যখন পৌঁছলাম, দেখলাম একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে ষ্টেশনে। দর্শনা-গেদে
বর্ডারে তেমন ভিড় হয়না। কিন্তু বিএসএফ-এর চেকিং শেষে ইমিগ্রেশনের কাজ করার সময়
চোখের সামনেই টেনটি ছেড়ে দিলো। সেটাই ছিলো পূর্বোল্লেখিত মেইল ট্রেন।
১৯৭১ সালে
কোলকাতায় তৎকালিন বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস এবং গঙ্গা নদীর উপরে পিলারবিহীন বিখ্যাত
হাওড়া ব্রিজ ছাড়া অন্য কিছু দেখা হয়নি। তবে এতোদিন যতোটা জেনে এসেছি, ঢাকার গুলশান
যেমন, কোলকাতার ধর্মতলাও তেমন। বিদেশী পর্যটকরা সব ওই এলাকাতেই অবস্থান করে। তাই
আমারও ইচ্ছা ছিলো ধর্মতলা গিয়ে উঠবো। কিন্তু ইমিগ্রেশন কাজে সহায়তাকারী স্থানীয়রা
পরামর্শ দিলো, কোলকাতা পৌঁছে রাতে ধর্মতলায় গিয়ে হোটেল খুঁজে নেয়া আপনার জন্যে
ঝুকিপূর্ণ হবে। তাই শিয়ালদহ ষ্টেশনের পাশেই হোটেল ‘ক্যালকাটা লজে’ আজকের রাতটা
অবস্থান করে সকালে ধর্মতলা গিয়ে হোটেল খুঁজে নিতে পারবেন এবং সেটাই করতে হলো।
হোটেল
‘ক্যালকাটা লজে’রই দু’জন স্টাফ পেলাম যাদের পূর্বের বাড়ি নাকি বাংলাদেশের নরসিংদী
ছিলো। কাউন্টারে বসা লোকটির আচরণ আমার পছন্দ হয়নি। লোকটাকে ঘোর সাম্প্রদায়িক মনে
হয়েছে। তবে ওই লোকটি ছাড়া স্থানীয় এবং বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অন্য যেসব লোকের সাথে
কথাবার্তা হয়েছে তেমনটি মনে হয়নি। বরং দু’একজন আগ বাড়িয়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত
তাদের আত্মীয়স্বজনদের গল্প, ঢাকা শহরের প্রশংসা এবং বাংলাদেশের লোকজনের আতীথেয়তা
তাদের খুব ভাল লেগেছে, ইত্যাদি আলাপ পেতেছে।
১৯৭১ সালে কোলকাতায়
দূর্গাপুজা দেখেছিলাম। ২০০৯-এ সময়ের চক্রে এবং কিছুটা ইচ্ছে করেই ঈদ-উল-অযহা’র সময়
কোলকাতা যাই। জানার কৌতুহল ছিলো, হিন্দুপ্রধান শহর কোলকাতায় মুসলমানরা কিভাবে ঈদ
উদযাপন করে,- বিশেষ করে কোরবাণীর ঈদ। যেদিন কোলকাতা যাই তার পরের দিনই ঈদের নামাজ।
মুসলমানদের বছরের সেরা দুই ধর্মীয় উৎসবের একটি ঈদ-উল-আয্হা। মনের উৎসুক্য-তো ছিলোই,
তাছাড়া একজন মুসলমান হিসেবে কিভাবে কোথায় নামাজ পড়বো তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম।
শিয়ালদহ ষ্টেশন
থেকে বেরিয়ে হোটেল ‘ক্যালকাটা লজ’ খোঁজার সময় এক মুসলমান পথচারীর সাথে দেখা হয়ে
গেল। তার কাছে এবং পরে হোটেল কর্মচারীদের কাছে জানতে পারলাম, পাশেই মসজিদ আছে
সেখানে নামাজ পড়তে পারবো।
হোটেল ক্যালকাটা
লজের অদূরেই প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরে মসজিদ। তবে প্রশস্ত মসজিদপ্রাঙ্গন প্রধান সড়কে
এসে মিশেছে। নামাজীদের ‘কাতার’ বা সারি বাড়তে বাড়তে প্রধান সড়ক অবধি পৌঁছে গেলে এক
নামাজী হাত উঁচু করতেই রাস্তার সব যানবাহন দাড়িয়ে গেলো। মুসল্লিরা যাতে সুষ্ঠভাবে
নামাজ পড়তে পারে, সেজন্যে ট্রাফিক পুলিশও যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছিলো। নামাজ শেষ না
হওয়া পর্য্ন্ত ট্রাম এবং গাড়িগুলি ওভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলো।
রাস্তায় বিছিয়ে
বসার মতো আমার কাছে কিছু না থাকায় ভিড় ঠেলে মসজিদ প্রাঙ্গনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
সম্ভবতঃ একই পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়স্বজন মিলে ছোটবড় দশ-বারোজনের একদল মুসল্লি
জায়নামাজ বিছিয়ে এক জায়গায় বসে আছে। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, রাস্তায়ই বোধহয়
আমাকে নামাজ পড়তে হবে। কিন্তু তারা আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবং ভিনদেশী জেনে
আন্তরিক আতিথেয়তায় আহবান জানালো, তাদের জায়নামাজে নামাজ পড়তে।
’মার্কসবাদী
সরকারের বুদ্ধদেব বসু তখন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিম বাংলার তৎকালিন(২০১৪)
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল মন্ত্রকের মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি, এমএলএ কোলকাতার নগরপিতা।
(২০০৯ সালের
ঘটনা এবং ২০১৪ সালের লেখা)…(চলবে)।