গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-২)

 


মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে আমি অসুস্থ অবস্থায় কল্যানী ট্র্যানজিট ক্যাম্পে চিকিৎসাধীন ছিলাম। চিকিৎসাধীন অবস্থায়ই ১৬ই ডিসেম্বর’ ১৯৭১ কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জিত হওয়ায় বিজয়োল্লাসে অসুস্থ শরীর নিয়েই মাতৃভূমির উদ্যেশ্যে যাত্রা করি। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ায় ভেবেছিলাম এতোদিনের লালিত বাসনা পূর্ণ করবো অর্থাৎ রানাঘাট-দর্শনা হয়ে রেলপথে দেশে যাবো। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা যাতে অবাধে চলাচল করতে না পারে সেজন্যে পাক-বাহিনী রেলপথের প্রায় সবগুলো সেতুর উপর ধ্বংসজজ্ঞ চালায় যা থেকে পাকশী’র বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রীজও রক্ষা পায়নি। ফলে ট্রেন চলাচল স্থাপিত না হওয়ায় বেনাপোল দিয়েই দেশে আসতে হলো। মনের লালিত বাসনা মনেই রয়ে গেলো।

 

জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে ধীরে ধীরে কর্মজীবনে প্রবেশ করায় সময় ও সুযোগের অভাবে স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ ৩৮ বছরেও আর কোলকাতা যাওয়া হয়নি। কিন্তু মনের বাসনা এক বিন্দুও দমিত হয়নি। অবশেষে ২০০৯ সালে বাসনা চরিতার্থ করার একটা সুযোগ বের করলাম।

 

তখন থাকতাম নারায়ণগঞ্জে। ওই সময়ে ঢাকা থেকে মাত্র ৫০০ টাকা ভাড়ায় ঢাকা-কোলকাতা সরাসরি বাস সার্ভিস চালু হয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জ থেকেও সরাসরি বাস ছাড়ে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ সড়কপথেই বেনাপোল হয়ে কোলকাতা যাতায়াত করে। কিন্তু আমার ‘বাতিক’ আমি আমার জন্মস্থানের উপর দিয়ে রেলপথে দর্শনা-রানাঘাট হয়ে কোলকাতা যাবো। সেই চিন্তা মাথায় নিয়েই দর্শনা রুটে গমনাগমনের কথা উল্লেখ করে ভিসা সংগ্রহ করে বাড়ি(রাজবাড়ি) চলে গেলাম।

 

কীভাবে ২০০৯ সালে মাত্র ৬২ টাকা ভাড়ায় রাজবাড়ি থেকে কোলকাতা গিয়েছিলাম সে গল্পটি বলছিঃ

রাজবাড়ি থেকে সকালে কোনো দূরপাল্লার ট্রেন ছেড়ে যায়না, যেটাতে সরাসরি দর্শনা যাওয়া যায়। সকালে একটি শার্টল ট্রেন পোড়াদহ পর্যন্ত যায়। পোড়াদহ থেকে উত্তরবঙ্গ থেকে ছেড়ে আসা যে কোনো ট্রেনে চেপে দর্শনা হল্ট ষ্টেশনে নামতে হয়। এখনো সেই অবস্থাই চালু আছে।

এভাবে দর্শনা যেতে ট্রেন ভাড়া লাগতো ২৫ টাকা। দর্শনা রেলষ্টেশন থেকে বর্ডার ইমিগ্রেশন চেকপোষ্ট পর্যন্ত রিকশা/ভ্যান ভাড়া লাগতো জনপ্রতি ৫ টাকা। বাংলাদেশি চেকপোষ্ট থেকে পশ্চিম বাংলার গেদে চেকপোষ্ট ও তৎসংলগ্ন রেল ষ্টেশনে হেঁটে যেতে মাত্র ৪/৫ মিনিট সময় লাগে। গেদে থেকে কোলকাতার শিয়ালদহ রেলষ্টেশন পর্যন্ত ভাড়া ভারতীয় ২২ রুপী অর্থাৎ বাংলাদেশি ৩২/৩৩ টাকা(২০০৯ সালের বিনিময় হার)।

 

এভাবেই মাত্র ৬২/৬৩ টাকা ভাড়া দিয়ে আজীবনের লালিত স্বপ্নের রুট দর্শনা-রানাঘাট দিয়ে পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের শহর কোলকাতায়।

১৯৭১ সালে অবশ্য শিকারপুর বর্ডার হয়ে যাওয়ার সময় কৃষ্ণনগর-রানাঘাট হয়েই কলকাতা গিয়েছিলাম, শুধু দর্শনা-গেদে বর্ডারে যাওয়া হয়নি তখন.

 

দর্শনা বর্ডার দিয়ে পশ্চিম বাংলায় প্রবেশ করে ইমিগ্রেশন শেষ করতে করে গেদে ষ্টেশন থেকে মেইল ট্রেনটি ছেড়ে চলে গেলো। পরবর্তীতে বিকেল ৫টা ২০মিঃএ লোকাল ট্রেন। ভাবলাম লোকাল ট্রেনে ঝক্কর ঝক্কর করতে করতে যাবোনা, পরের মেইল ট্রেনে যাবো। কিন্তু পরের মেইল ট্রেনে গেলে কোলকাতা যেতে যেতে রাত বেশি হয়ে যাবে, তাছাড়া ওখানকার সবাই বললো, লোকাল ট্রেন হলেও ৩ ঘন্টায় অর্থাৎ রাত ৮টা ২০মিঃএ আপনি কোলকাতা পৌঁছে যাবেন। সত্যিই তাই, ঘড়ির কাঁটা ৫টা ২০মিঃ হওয়ামাত্র ট্রেন ছেড়ে দিলো এবং ঠিক রাত ৮টা ২০মিঃএ কোলকাতার শিয়ালদহ ষ্টেশনে পৌঁছে গেলো, সময়ের একটুও ব্যাতিক্রম হলোনা।

 

আমি ভারতের পশ্চিম বাংলা ছাড়া অন্য কোন প্রদেশে যাইনি। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম যখন পশ্চিম বাংলায় পা রাখি এবং ট্রেনে চেপে কৃষ্ণনগর থেকে কোলকাতা যাই, পথে ইচ্ছে করেই রানাঘাট ষ্টেশনে নেমেছিলাম জংশন ষ্টেশন দেখার জন্যে এবং কিছুটা পূর্বকল্পিত স্মৃতি রোমন্থন করা জন্য। কারণ এই রানাঘাট ষ্টেশন নিয়েও আমার একটা কৌতূহল ছিল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের আগে যখন সরাসরি ঢাকা-কোলকাতা ট্রেন যাতায়াত করতো, তখন আমাদের এলাকার অনেক হকার নাকি কৌশলে রানাঘাট পর্যন্ত চলে যেতো। কোলকাতা থেকে গোয়ালন্দের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ট্রেনের সাথে যাওয়ার ট্রেনের ক্রসিং হতো। সেই ট্রেনে তারা ফেরৎ আসতো।

 শৈশবে বয়ঃজেষ্ঠ সেসব হকারদের কাছে রানাঘাট ষ্টেশন সম্বন্ধে নানা গল্প শুনে ষ্টেশনটি সম্বন্ধে একটা কৌতূহল অন্মেছিলো।

 

১৯৭১ সালে যেটা নজরে পড়েছিলো, ২০০৯ সালে দেখলাম তার ভিন্ন চিত্র। ১৯৭১ সালে পশ্চিম বাংলায় এক ধরনের মাটির কাপে হকাররা ট্রেনে চা বিক্রী করে বেড়াতো। যাত্রীরা ১০ পয়সা (এখনকার নবপ্রজন্ম হয়তো ১০ পয়সা চেনেওনা) দিয়ে এক কাপ চা কিনে খেয়ে কাপটা প্লাটফর্মের নিচে ছুড়ে ফেলে দিতো। কাপগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেতো এবং প্লাটফর্মের নিচে রেল লাইনে ভাঙ্গা কাপের স্তুপ জমে থাকতো।

 

কিন্তু এখনকার(২০০৯) চিত্র ভিন্ন। গেদে ষ্টেশনে পৌঁছেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। দেশের এক প্রান্তে ছোট্ট একটি রেলষ্টেশন অথচ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা আর নিয়ম-কানুন দেখে অবাক হয়ে গেলাম। প্লাটফর্ম এমনকি রেল লাইনও পরিস্কার ঝকঝকে। প্লাটফর্মে একটি চায়ের ষ্টল আছে কিন্তু এখন আর মেটে কাপে চা বিক্রী হয়না। ছোট ছোট কাচের গ্লাসে চা পাওয়া যায়। শহরে কোনো কোনো ষ্টলে ‘ওয়ানটাইম’ প্লাস্টিক কাপ আছে তবে চা পানের পর তা নিজ দায়িত্বে দোকানের পাশে রাখা ডাস্টবিনে ফেলতে হবে।

ট্রেনে আর আগের মতো চা ফেরি করে বেচতে দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা। তবে ৩৮/৪০ বছর আগে দেখা সেই ভাঙ্গা মেটে কাপের স্তুপ নজরে পরেনি।

 

ভারতীয় রেল যোগাযোগ ব্যাবস্থা এখনও(২০০৯) এতো সুশৃঙ্খল যে, যারা ভারতে গিয়েছে বা এখনও সচরাচর যায় তারা ছাড়া মনেহয় অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেনা; একটা লোকাল ট্রেনও ১ মিনিট সময় অপচয় করেনা। লোকাল বলতে ট্রেনটি প্রতিটা ষ্টেশনেই যাত্রী ওঠা-নামা করায়। কোনো মাল পরিবহন করেনা বা তার সাথে কোন মালগাড়ির বগি জুড়ে দেয়া হয়না।

 

একমাত্র রানাঘাট জংশন ষ্টেনশনে প্রায় আধাঘন্টা বিরতি। এছাড়া অন্য সব ষ্টেশনে মাত্র ১৫ সেকেন্ড বিরতিতে লোক ওঠা-নামা করতে হয়। ট্রেনগুলোর দরজা বেশ বড় এবং মাঝখানে একটা খুঁটির মতো থাকায় ১৫ সেকেন্ডে অনায়াসে লোকজন ওঠা-নামা করতে পারে। রানাঘাটের পরে কিছু বড় ষ্টেশনে মেইল ট্রেন ‘পাস’ দেয়ার জন্যে একটু বেশি সময় নেয়, তাও ২-৫ মিনিটের বেশি না (২০০৯ সালের ঘটনা)।......(চলবে)।

 

 

 

 

 গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব - ২)

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে আমি অসুস্থ অবস্থায় কল্যানী ট্র্যানজিট ক্যাম্পে চিকিৎসাধীন ছিলাম। চিকিৎসাধীন অবস্থায়ই ১৬ই ডিসেম্বর’ ১৯৭১ কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জিত হওয়ায় বিজয়োল্লাসে অসুস্থ শরীর নিয়েই মাতৃভূমির উদ্যেশ্যে যাত্রা করি। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ায় ভেবেছিলাম এতোদিনের লালিত বাসনা পূর্ণ করবো অর্থাৎ রানাঘাট-দর্শনা হয়ে রেলপথে দেশে যাবো। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা যাতে অবাধে চলাচল করতে না পারে সেজন্যে পাক-বাহিনী রেলপথের প্রায় সবগুলো সেতুর উপর ধ্বংসজজ্ঞ চালায় যা থেকে পাকশী’র বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রীজও রক্ষা পায়নি। ফলে ট্রেন চলাচল স্থাপিত না হওয়ায় বেনাপোল দিয়েই দেশে আসতে হলো। মনের লালিত বাসনা মনেই রয়ে গেলো।

 

জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে ধীরে ধীরে কর্মজীবনে প্রবেশ করায় সময় ও সুযোগের অভাবে স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ ৩৮ বছরেও আর কোলকাতা যাওয়া হয়নি। কিন্তু মনের বাসনা এক বিন্দুও দমিত হয়নি। অবশেষে ২০০৯ সালে বাসনা চরিতার্থ করার একটা সুযোগ বের করলাম।

 

তখন থাকতাম নারায়ণগঞ্জে। ওই সময়ে ঢাকা থেকে মাত্র ৫০০ টাকা ভাড়ায় ঢাকা-কোলকাতা সরাসরি বাস সার্ভিস চালু হয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জ থেকেও সরাসরি বাস ছাড়ে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ সড়কপথেই বেনাপোল হয়ে কোলকাতা যাতায়াত করে। কিন্তু আমার ‘বাতিক’ আমি আমার জন্মস্থানের উপর দিয়ে রেলপথে দর্শনা-রানাঘাট হয়ে কোলকাতা যাবো। সেই চিন্তা মাথায় নিয়েই দর্শনা রুটে গমনাগমনের কথা উল্লেখ করে ভিসা সংগ্রহ করে বাড়ি(রাজবাড়ি) চলে গেলাম।

 

কীভাবে ২০০৯ সালে মাত্র ৬২ টাকা ভাড়ায় রাজবাড়ি থেকে কোলকাতা গিয়েছিলাম সে গল্পটি বলছিঃ

রাজবাড়ি থেকে সকালে কোনো দূরপাল্লার ট্রেন ছেড়ে যায়না, যেটাতে সরাসরি দর্শনা যাওয়া যায়। সকালে একটি শার্টল ট্রেন পোড়াদহ পর্যন্ত যায়। পোড়াদহ থেকে উত্তরবঙ্গ থেকে ছেড়ে আসা যে কোনো ট্রেনে চেপে দর্শনা হল্ট ষ্টেশনে নামতে হয়। এখনো সেই অবস্থাই চালু আছে।

এভাবে দর্শনা যেতে ট্রেন ভাড়া লাগতো ২৫ টাকা। দর্শনা রেলষ্টেশন থেকে বর্ডার ইমিগ্রেশন চেকপোষ্ট পর্যন্ত রিকশা/ভ্যান ভাড়া লাগতো জনপ্রতি ৫ টাকা। বাংলাদেশি চেকপোষ্ট থেকে পশ্চিম বাংলার গেদে চেকপোষ্ট ও তৎসংলগ্ন রেল ষ্টেশনে হেঁটে যেতে মাত্র ৪/৫ মিনিট সময় লাগে। গেদে থেকে কোলকাতার শিয়ালদহ রেলষ্টেশন পর্যন্ত ভাড়া ভারতীয় ২২ রুপী অর্থাৎ বাংলাদেশি ৩২/৩৩ টাকা(২০০৯ সালের বিনিময় হার)।

 

এভাবেই মাত্র ৬২/৬৩ টাকা ভাড়া দিয়ে আজীবনের লালিত স্বপ্নের রুট দর্শনা-রানাঘাট দিয়ে পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের শহর কোলকাতায়।

১৯৭১ সালে অবশ্য শিকারপুর বর্ডার হয়ে যাওয়ার সময় কৃষ্ণনগর-রানাঘাট হয়েই কলকাতা গিয়েছিলাম, শুধু দর্শনা-গেদে বর্ডারে যাওয়া হয়নি তখন.

 

দর্শনা বর্ডার দিয়ে পশ্চিম বাংলায় প্রবেশ করে ইমিগ্রেশন শেষ করতে করে গেদে ষ্টেশন থেকে মেইল ট্রেনটি ছেড়ে চলে গেলো। পরবর্তীতে বিকেল ৫টা ২০মিঃএ লোকাল ট্রেন। ভাবলাম লোকাল ট্রেনে ঝক্কর ঝক্কর করতে করতে যাবোনা, পরের মেইল ট্রেনে যাবো। কিন্তু পরের মেইল ট্রেনে গেলে কোলকাতা যেতে যেতে রাত বেশি হয়ে যাবে, তাছাড়া ওখানকার সবাই বললো, লোকাল ট্রেন হলেও ৩ ঘন্টায় অর্থাৎ রাত ৮টা ২০মিঃএ আপনি কোলকাতা পৌঁছে যাবেন। সত্যিই তাই, ঘড়ির কাঁটা ৫টা ২০মিঃ হওয়ামাত্র ট্রেন ছেড়ে দিলো এবং ঠিক রাত ৮টা ২০মিঃএ কোলকাতার শিয়ালদহ ষ্টেশনে পৌঁছে গেলো, সময়ের একটুও ব্যাতিক্রম হলোনা।

 

আমি ভারতের পশ্চিম বাংলা ছাড়া অন্য কোন প্রদেশে যাইনি। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম যখন পশ্চিম বাংলায় পা রাখি এবং ট্রেনে চেপে কৃষ্ণনগর থেকে কোলকাতা যাই, পথে ইচ্ছে করেই রানাঘাট ষ্টেশনে নেমেছিলাম জংশন ষ্টেশন দেখার জন্যে এবং কিছুটা পূর্বকল্পিত স্মৃতি রোমন্থন করা জন্য। কারণ এই রানাঘাট ষ্টেশন নিয়েও আমার একটা কৌতূহল ছিল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের আগে যখন সরাসরি ঢাকা-কোলকাতা ট্রেন যাতায়াত করতো, তখন আমাদের এলাকার অনেক হকার নাকি কৌশলে রানাঘাট পর্যন্ত চলে যেতো। কোলকাতা থেকে গোয়ালন্দের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ট্রেনের সাথে যাওয়ার ট্রেনের ক্রসিং হতো। সেই ট্রেনে তারা ফেরৎ আসতো।

 শৈশবে বয়ঃজেষ্ঠ সেসব হকারদের কাছে রানাঘাট ষ্টেশন সম্বন্ধে নানা গল্প শুনে ষ্টেশনটি সম্বন্ধে একটা কৌতূহল অন্মেছিলো।

 

১৯৭১ সালে যেটা নজরে পড়েছিলো, ২০০৯ সালে দেখলাম তার ভিন্ন চিত্র। ১৯৭১ সালে পশ্চিম বাংলায় এক ধরনের মাটির কাপে হকাররা ট্রেনে চা বিক্রী করে বেড়াতো। যাত্রীরা ১০ পয়সা (এখনকার নবপ্রজন্ম হয়তো ১০ পয়সা চেনেওনা) দিয়ে এক কাপ চা কিনে খেয়ে কাপটা প্লাটফর্মের নিচে ছুড়ে ফেলে দিতো। কাপগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেতো এবং প্লাটফর্মের নিচে রেল লাইনে ভাঙ্গা কাপের স্তুপ জমে থাকতো।

 

কিন্তু এখনকার(২০০৯) চিত্র ভিন্ন। গেদে ষ্টেশনে পৌঁছেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। দেশের এক প্রান্তে ছোট্ট একটি রেলষ্টেশন অথচ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা আর নিয়ম-কানুন দেখে অবাক হয়ে গেলাম। প্লাটফর্ম এমনকি রেল লাইনও পরিস্কার ঝকঝকে। প্লাটফর্মে একটি চায়ের ষ্টল আছে কিন্তু এখন আর মেটে কাপে চা বিক্রী হয়না। ছোট ছোট কাচের গ্লাসে চা পাওয়া যায়। শহরে কোনো কোনো ষ্টলে ‘ওয়ানটাইম’ প্লাস্টিক কাপ আছে তবে চা পানের পর তা নিজ দায়িত্বে দোকানের পাশে রাখা ডাস্টবিনে ফেলতে হবে।

ট্রেনে আর আগের মতো চা ফেরি করে বেচতে দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা। তবে ৩৮/৪০ বছর আগে দেখা সেই ভাঙ্গা মেটে কাপের স্তুপ নজরে পরেনি।

 

ভারতীয় রেল যোগাযোগ ব্যাবস্থা এখনও(২০০৯) এতো সুশৃঙ্খল যে, যারা ভারতে গিয়েছে বা এখনও সচরাচর যায় তারা ছাড়া মনেহয় অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেনা; একটা লোকাল ট্রেনও ১ মিনিট সময় অপচয় করেনা। লোকাল বলতে ট্রেনটি প্রতিটা ষ্টেশনেই যাত্রী ওঠা-নামা করায়। কোনো মাল পরিবহন করেনা বা তার সাথে কোন মালগাড়ির বগি জুড়ে দেয়া হয়না।

 

একমাত্র রানাঘাট জংশন ষ্টেনশনে প্রায় আধাঘন্টা বিরতি। এছাড়া অন্য সব ষ্টেশনে মাত্র ১৫ সেকেন্ড বিরতিতে লোক ওঠা-নামা করতে হয়। ট্রেনগুলোর দরজা বেশ বড় এবং মাঝখানে একটা খুঁটির মতো থাকায় ১৫ সেকেন্ডে অনায়াসে লোকজন ওঠা-নামা করতে পারে। রানাঘাটের পরে কিছু বড় ষ্টেশনে মেইল ট্রেন ‘পাস’ দেয়ার জন্যে একটু বেশি সময় নেয়, তাও ২-৫ মিনিটের বেশি না (২০০৯ সালের ঘটনা)।......(চলবে)।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url