হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি - কি হওয়া উচিৎ, আমরা কি করি?
শুরুতেই যে
৩০ সেকেন্ডের ভিডিওটি দেখলেন এবং ভক্তিমূলক বা সম্প্রীতির গান শুনলেন, গানটি ভারতের
রাজধানী দিল্লীর বদরপুরস্থ “আল-ইলসাহ ন্যাশনাল একাডেমী” নামক একটি মাদ্রাসায় ক্লাস
শুরুর আগে এসেম্বলিতে একটি ছেলের কণ্ঠে গাওয়া। গানটি নেয়া হয়েছে ১৯৫৯ সালে নির্মিত
ছায়াছবি “ধুল কা ফুল”-(Flower of Dust) থেকে। মূল গানটি গেয়েছেন মোহাম্মদ রফি।
স্বাগত সবাইকে
ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের
সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই অবস্থান নেতিবাচক। কিন্তু আমরা মুসলমানরা জানি, ইহুদী খ্রিষ্টান
সহ আব্রাহামিক সকল ধর্মাবলম্বীদের কোরআন মুসলিম বলেছে। “সুরা বাকারার ৬২” এবং “সুরা
মায়েদার ৬৯” নং আয়াতে ইহুদী, খৃষ্টান, সাবেঈন সহ যারাই শ্রষ্টা ও পরকালে বিশ্বাস করে
এবং ভাল কাজ করে তাদেরকে আল্লাহ জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।
“নিশ্চয়ই মুসলিম,
ইয়াহুদী, খৃষ্টান এবং সাবেঈন সম্প্রদায়, (এদের মধ্যে) যারা আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামাতের
প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং ভাল কাজ করে, তাদের জন্য তাদের রবের নিকট পুরস্কার রয়েছে, তাদের
কোন প্রকার ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবেনা”- (২:৬২)।
“এটা সুনিশ্চিত
যে, মুসলিম, ইয়াহুদী, সাবেঈ এবং খৃষ্টানদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামাতের
প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং সৎ কাজ করে, এইরূপ লোকদের জন্য শেষ দিনে না কোন প্রকার ভয় থাকবে
আর না তারা চিন্তান্বিত হবে”- (৫:৫৯)।
ড: আবু বক্কর
মহাম্মদ জাকারিয়া এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী ‘সাবেঈ’ হচ্ছে বিভিন্ন গ্রহ, নক্ষত্রের
পুজারী মতান্তরে ফেরেশতাদের উপাসনাকারী বা যাদের সুনির্দিষ্ট, সুসংগঠিত ধর্ম নাই, সনাতন
বা প্রথাভিত্তিক ধর্মাবলম্বী।
এই লেখায় হিন্দু
ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা করবো যা হিন্দু, মুসলমান
অনেকের কাছেই কিছুটা অপরিচিত মনে হবে। কারণ ধর্মের নামে রাজনীতি, বিভাজন, বিভক্তি,
রক্তপাত যাদের পকেট ভারি করছে, তারা বিভিন্ন উদ্ভট বক্তব্য ও একপেশে তথ্য উপাত্ত জোগাড়
করে আমাদেরকে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করাতেই তৎপর।
বাবরী মসজিদ
ভেঙে রামমন্দির বানানো, কাষ্মীরে গনহত্যা, নাগরিকত্ব বিলের নামে মুসলমানদের ভারত থেকে
বিতাড়ণ, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান ভাগ, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা জিইয়ে রাখা,
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের কিছু কিছু জায়গায় হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নি-সংযোগ, লুটপাট,
জায়গাজমি দখল ইত্যাদির মাধ্যমে দেশত্যাগে বাধ্য করা; - সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক।
এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নাই। ইসলাম বা হিন্দু কোনো ধর্মগ্রন্থেই এ বর্বরতায় একবিন্দু
পূণ্যও রাখেননি শ্রষ্টা। বরং এসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যে হিন্দুরা মুসলমানদের আশ্রয়
দিয়েছে বা যে মুসলমানরা হিন্দুদের সুরক্ষার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে, তারাই প্রকৃত ধার্মিক।
আমি ভিন্ন
ধর্মাবলম্বী এমনকি নাস্তিকদের সম্পর্কে কথা বলার ক্ষেত্রেও এটা মাথায় রাখি যে, তারা
আমার কথাগুলো শুনছেন বা শুনবেন। তাদের বিশ্বাসের প্রতি সম্মান রেখেই আমার মতামত দেয়ার
চেষ্টা করি। ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে কোরআনের নির্দেশণাও তাই। কিন্তু যারা ভিন্নমতকে
সম্মান দেখানোর মধ্যে ষঢ়যন্ত্র বা দালালী খোঁজেন এবং তাদের নিকৃষ্ট ভাষায় গালিগালাজ
করাকে পূণ্য মনে করেন,- তারা দয়াকরে আমার লেখা থেকে দূরে থাকবেন। আপনি আপনার বুঝমতো
চলুন। গালাগালি করে ‘অশেষ নেকী’ হাসিল করার দরকার নাই।
আমি একজন মুসলিম
হিসেবে গর্বিত, একই সাথে আমি কিছু সংখ্যক ‘তথাকথিত’ মুসলমানদের জন্য লজ্জিত। আশাকরি
নিশয়ই আমার এ স্পষ্ট কথা বুঝতে পেরেছেন।
কোরআনে সব
ধর্মাবলম্বীদের নাম উল্লেখ না করা হলেও বিভিন্ন বিশ্বাসকে বিশেষায়িত করে যেমন; কাফের
বা নাস্তিক, মুশরিক বা যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে এবং মুনাফেক বা ছদ্দবেশী ধার্মিক
তাদের পরিনাম নিয়ে বলা হয়েছে। কাফের, মুশরিক বা মুনাফেকদের পরিণাম বা পরিণতি বেশ স্পষ্ট।
যদিও আমরা ধার্মিকরাও শিরক, কুফরী বা মুনাফেকীতে- ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় বা অজ্ঞতাবশতঃ জড়িয়ে
যাই।
তাই আপাতঃদৃষ্টিতে
কাউকে ধার্মিক মনে হলেও সে আল্লাহর দৃষ্টিতে কাফের, মুশরিক বা মুনাফেক হতে পারে। আবার
আপাতঃদৃষ্টিতে কাউকে কাফের বা মুশরিক মনে হলেও তার অন্তরের বিশ্বাস একমাত্র আল্লাহই
ভালো জানেন।
হিন্দু শব্দটি
যেহেতু কোরআনে উল্লেখ করা হয়নি, তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে কোনো ‘পাইকারী
সিদ্ধান্ত’ দেয়া যাবে না। তাদের পরিণতি সম্পর্কে আমাদের এভারেজ মুসলমানদের সিদ্ধান্ত
মুলতঃ তাদের বিশ্বাসভিত্তিক। অর্থাৎ তারা যেহেতু মূর্তিপুজা করে, বহু ইশ্বরে বিশ্বাস
করে তাই তারা মুশরিক!
যাইহোক, এটা
তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে আমাদের সুবিধাজনক মডেল! হিন্দুদের মধ্যে যাদেরকে উদাহরণ হিসেবে
নিলে পুরো হিন্দু ধর্মকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে তাদেরকেই আমরা হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি
বিবেচনা করি! ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করার ক্ষেত্রে এ মডেল বেশ জনপ্রিয়।
যেমন; শিয়ারা এই এই বিশ্বাস করে, তাই তারা কাফের! খৃষ্টানরা ইত্যাদি ইত্যাদি বিশ্বাস
করে, তাই তারা মুশরিক, সুন্নীরা এমনটা বিশ্বাস করে, সুতরাং তারা বেদাতী, ইত্যাদি ইত্যাদি!
সব ধর্মেই
এমন কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদেরকে সে ধর্মের ‘মালিক’ মনে করে। কিন্তু এরা এতোই ধর্মান্ধ,
মুর্খ, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ইতর শ্রেণীর, যারা মানুষ হিসাবেই বিবেচিত হতে পারে না। তাদেরকে
বিবেচনায় নিয়ে ধর্ম বা মাযহাবকে মূল্যায়ন করলে সেকুলারেই সমাধান দেখবেন।
আমি হিন্দু
ধর্ম সম্পর্কে সামান্য যা জানি তার ভিত্তিতে হিন্দুদের বিশ্বাসকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা
করবো এবং তাদের সম্পর্কে কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করবো, অন্তর্ভুক্তিমূলক
দৃষ্টিকোণথেকে। অর্থাৎ আমারটাও ঠিক, একইসাথে আপনারটাও ঠিক হতে পারে। তবে আমার এ লেখা
যারা পড়বেন তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মতামত থাকবে অবশ্যই। আপনারা কমেন্টে আপনাদের মতামত,
দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করলে, পাঠকরা লেখার পাশাপাশি কমেন্ট সেকশন থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি
পায়। তবে যারা ভিন্নমত দেয়ার ক্ষেত্রে ন্যুনতম ভদ্রতা প্রদর্শন করতে জানেন না, সেসব
ইতরশ্রেণীর লোকদের আমি তর্ক করি না। জাস্ট ব্লক করে দেই। কারণ, তাদের সাথে তর্ক করতে,
তাদের লেভেলে নামা আমার কাছে সঠিক বলে মনে হয় না।
হিন্দু শব্দটা
ধর্মীয় পরিচয় নয়, এটা ভৌগলিক পরিচয়। গ্রীকরা যখন ইন্ডিয়া জয় করে তারা নর্থ-ওয়েষ্ট ইন্ডিয়ান
রিভার ‘সিন্ধু’ বা স্থানীয় ভাষায় ইন্দু নদীর তীরের অধিবাসীদের ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে
‘ইন্দু’ বলে সম্বোধন করে। পরবর্তীতে আরবরা এই পুরো ভৌগলিক অঞ্চলের নাম দেয় ইন্ডিয়া।
ইন্দু থেকে ইন্ডিয়া। হিন্দু শব্দটাকে ধর্মীয় পরিচয় হিসাবে অফিসিয়ালী ব্যবহার করে বৃটিশরা।
তারা এই অঞ্চলের নন-আব্রাহামিক সব ধর্মাবলম্বীকেই হিন্দু বলে সম্বোধন করে। তাই আজকের
হিন্দু ধর্মের ভিতর অনেকগুলো ধর্ম বা ভার্ষণ আছে। রাম, কৃষ্ণ, শিব, গণেশ, হনুমান- অনেক
অনেক ভগবানের পুজারী আছে, যা থেকে আন্দাজ করা যায় যে, এরা এক সময় স্বতন্ত্র ধর্মাবলম্বী
ছিলো।
ধর্ম হিসাবে
হিন্দু শব্দটা প্রথম পর্যায়ে মূলতঃ চাপিয়ে দেয়া। কিন্তু সময়ের আবর্তে উপমহাদেশের সকল
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের হিন্দু পরিচয়কে মেনে নিয়েছে। শব্দটা হিন্দুস্থানী জাতীয়তাবাদের
অন্যতম প্রধান উপকরণও।
হিন্দুদের
প্রাচীন ধর্মগ্রন্থেও হিন্দু শব্দটি নেই। “বেদ”কে সকল সনাতন ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ
হিসেবে মানা হলেও বৈদিক রচনাবলীতে ধর্ম হিসাবে হিন্দু শব্দটির ব্যবহার করা হয়নি।
রামায়ন, মহাভারত
‘হিন্দুইজমে’র ধারণার চেয়ে অনেক পুরনো। যে কোনো কারণেই হোক, যেহেতু এ দুটি গ্রন্থ হিন্দুদের
কাছে পবিত্র, তাই আমরা মুসলমানরা এই কালোত্তীর্ণ জ্ঞানভান্ডারকে ‘পাইকারীভাবে বাতিল
করেছি!
আজকের প্রচলিত
হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে কোরআনে স্পষ্ট বর্ণনা নেই বা থাকার কথাও নয়। তারা সাবেঈন হিসেবে
বিবেচিত কিনা তা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে যারাই শ্রষ্টায় বিশ্বাস করে, পরকালকে বিশ্বাস
করে এবং সৎকাজ করে কোরআন অনুযায়ী তারা কোয়ালিফাইড।
হিন্দুরা শ্রষ্টা
ও পরকালে বিশ্বাস করে তাই কোরানে সৎকর্মের যে তালিকা সেই অনুযায়ী অনেক সৎকর্মশীল হিন্দু
ধর্মাবলম্বীকে আমি, আপনিও ব্যক্তিগতভাবে চিনি।
তবে আজকের
হিন্দুধর্মের অনেক চর্চাকে হিন্দু পণ্ডিতরাও অধর্ম বলছেন। ধর্ম সম্পর্কিত তুলনামূলক
জনপ্রিয় বিতর্ক(ডিবেট), সংলাপ থেকে আমরা জানি, হিন্দু ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থে মূর্তিপুজা
এবং বহুদেবতার উল্লেখ নাই।
যদি হিন্দু
শাস্ত্র অনুযায়ী সর্বশক্তিমান ইশ্বর একজন হন এবং তার কোনো প্রতিমূর্তি না থাকে তবে
তাত্বিকভাবে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য
কেবল প্রাক্টিসে। এখন প্রাক্টিসের তুলনার ক্ষেত্রে দুই ধর্মেরই বেষ্ট প্রাক্টিশনারদের
এক্সাম্পল হিসাবে নিতে হবে। বেষ্ট মুসলিম বনাম বেষ্ট হিন্দু।
যারা ধর্মের
ভুল চর্চা করে, ধর্মকে হাটে-মাঠে বিক্রী করে তারা কোনো ধর্মেরই প্রতিনিধি নয়। যারা
মূল ধর্মগ্রন্থগুলো পড়ে, গোঁড়ামি বা পক্ষপাৎদুষ্ট না হয়ে চিন্তা, গবেষণা করে, ধর্মের
প্রকৃত শিক্ষা উপলব্ধি করে, চর্চা করে, তারাই প্রকৃত ধার্মিক।
ধর্মের ভুল
চর্চা বা শিরক, কুফরী, মুনাফেকী খুঁজতে আমাদের হিন্দু বাড়িতে যেতে হবে না। ইসলাম ধর্মেরই
এমন হাজারও ‘ভার্ষণ’ আছে যা দেখলে আপনিও বলবেন, ভাই, এ আবার কোন ধর্ম!
মাজার সেজদারত একদল ধর্মানুরাগী |
এই কিম্ভুত
কিমাকার ইসলামের সাথে কোরআনের কোনো সম্পর্ক নাই। কোরানের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, সারমর্ম,
তাৎপর্য, ‘ভাব সম্প্রসারণ’ ইত্যাদি নাম দিয়ে কথিত হাদিস, ফিকাহ, ইজমা, কিয়াস, দোয়া,
দরুদ, কিচ্ছা, কাহিনীর মনগড়া বই রচনা করে দিনশেষে সে সবকেই আমরা ধর্ম হিসাবে পালন করি।
আশাকরি সবাই
একমত হবেন যে, ‘লাল শালু’ রচয়িতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যথার্থ বলেছেন। “শস্যের চেয়ে টুপি
বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি”।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের
মধ্যেও এমন বিশ্বাস বা চর্চা আছে যার সাথে মৌলিক হিন্দুশাস্ত্রের কোনো সম্পর্ক নাই।
সতীদাহ বা বিধবা বিবাহে নিষেধাজ্ঞা হিন্দু শাস্ত্রে না থাকলেও এ প্রথা এক সময় হিন্দু
সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলো।
সব ধর্মের
মুল গ্রন্থগুলো নিয়েই জালিয়াতির ইতিহাস আছে। অর্থ না বুঝে কোরআন পড়তে, শুনতে বা মুখস্ত
করতে বলেন আমাদের আলেমরা। কারণ, অর্থসহ পড়লেই বুঝবেন, ইসলাম ধর্মে আলেমের কোনো পদ-পদবীই
নাই। কোরআন নিজেই সবচেয়ে বড় ‘মুফাসসিরে কোরআন।
অর্থ না বুঝলে
ফিজিক্সের বইও যা, কবিতার বইও তা। চায়নীজ ভাষা, কোরিয়ান ভাষা সব একই রকম শোনা যায়-
কারণ, বুঝিনা।
একইভাবে একসময়
সাধারণ হিন্দুদের বেদ শোনাও গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো। ভগবত গীতার ‘গুপ্তধন’
উদ্ধারে যাদের সাহায্য চাইবেন তারা আপনাকে ছাত্র হিসাবে নয়, ‘খরিদ্দার’ হিসাবে দেখবে।
বেদ, গীতার নিঃস্বার্থ শিক্ষক ডুমুরের ফুলের চেয়েও দূর্লভ।
স্বামী বিবেকানন্দ
একবার গীতা রূপকথাকে দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘ভগবত গীতা মহাভারতের যে
বিষয়টি মহাভারতকে প্রভাবিত করে, তা হলো দুই কাজিনপক্ষ অর্থাৎ কৌরব এবং পাণ্ডবের মধ্যে
একটি মহান যুদ্ধ। পাণ্ডবরা ছিলো সৎ, মহৎ, এবং ন্যায়পরায়ণ। আর কৌরবরা ছিলো তার ঊল্টা।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপ্রিন্স অর্জুন দেখলেন, দুই পক্ষই তার পরিবারের সদস্য।
হার-জিত যাই হোক, তিনি তার নিকট আত্মীয়দেরই হারাবেন। তখন তিনি তার উপদেষ্টা ‘লর্ড শ্রীকৃষ্ণ’র
(হিন্দুরীতি অনুযায়ী কৃষ্ণকে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ’ বলা হয়) কাছে পরামর্শ চাইলেন। কৃষ্ণ
তাকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন, তার নৈতিক দায়িত্ব হিসাবে। কুরুক্ষেত্রে প্রিন্স
অর্জুন এবং ‘লর্ড কৃষ্ণ’র মধ্যে যে কথোপকথন সে অংশটুকুই মূলতঃ ভগবত গীতা।
পুরো অংশটুকু
রূপকার্থে নিলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটা প্রতিটা মানুষের জীবনযুদ্ধ! যেখানে ‘পান্ডব’
হচ্ছে আমাদের ইতিবাচক শক্তি আর ‘কৌরব’ হচ্ছে আমাদের ভিতরের অপশক্তি।
অমূলক ভয়ভীতি,
সন্দেহ, সংশয়, হিংসা, অহংকার, লোভ স্বার্থপরতা, অজ্ঞতা, গোঁড়ামী। এরা কৌরব তথা আমাদের
পরিবারের সদস্যের মতো। কারণ এদের সাথেই বসবাস করি, এদের সাথেই বেড়ে উঠি। এরা আমাদের
খুবই পরিচিত। আমরা এদের সাথে যুদ্ধ করতে চাই না। আমরা জানি, এরা আমাদের জীবনযুদ্ধের
সাফল্য, স্বার্থকতার প্রধান প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু আমরা এদের হত্যা করতে চাই না। নিজের
ভিতরের এই ‘মন্দশক্তি’র সাথে যুদ্ধই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ। এই অমূলক ভয়ভীতি,
দুশ্চিন্তা, দূর্ভাবনা নিত্য নতুন রূপে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে। এই অবসম্ভাবী যুদ্ধ
জয়ের মন্ত্রই ‘ভগবত গীতা’।
স্বামীজীকে
একজন জিজ্ঞ্যেস করলেন, হিন্দু শাস্ত্রে বহুদেবতা বা মূর্তিপুজার কথা না থাকলেও আপনারা
কেনো বহু ভগবানের মূর্তি বানিয়ে তাদের পুজা করেন?- স্বামীজী জবাব দিলেন, “আমরা একজন
ভগবানেরই ভিন্নভিন্ন গুণের পুজা করি। যেমন; আপনারা রহিম, রহমান বিভিন্ন নামে একজন ইশ্বরকেই
ডাকেন”। আর মূর্তি বানানো? স্বামীজী জবাব দিলেন, “আমরা কোনো মুর্তির পুজা করিনা। সে
মূর্তিরূপে প্রকৃত ভগবানের পুজা করি। কোনো ছবি বা প্রতিকৃতি নয়, ছবির মানুষটাকেই তার
প্রাপ্য সম্মান দেই। কোনো মানুষ নয়, তার গুণের পুজা করি”। ন্যুনতম বোধবুদ্ধি সম্পন্ন
কোনো হিন্দু পাথরের মূর্তিকে ভগবান মনে করে না। বরং ভগবানের মূর্তি বা কল্পিত রূপ হিসাবে
বিশ্বাস করে, ভক্তি করে।
স্বামী বিবেকানন্দের
ভগবানের মূর্তি বানানোর এবং সে মূর্তিররুপের ইশ্বরের পুজা করার ব্যাখ্যা কার কাছে কতোটুকু
গ্রহণযোগ্য হবে জানিনা। তবে আমরা আমাদের সাধারণ বিবেচনাবোধ থেকে শহীদ মিনারের স্মৃতিসৌধে
জুতা পায়ে উঠি না। ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু এ ইঁট পাথরের ইমারতের শহীদরা
কোথায়?
ক্কাবার ছবি
ফটশপে এডিট করে দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়ার বহু ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ওটা তো ক্কাবা নয়, ক্কাবার
ছবি। ক্কাবা যেখানে ছিলো সেখানেই আছে এবং সুরক্ষিতই আছে।
সম্প্রতি করোনা
প্যান্দামিকের কারণে ক্কাবার দরজা বন্ধ করা নিয়ে ক্কাবার একজন সম্মানিত ইমাম খুব দারুণ
একটা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মুসলিমদের আমরা একটা মেসেজ দিতে চাই যে, আমরা এ ঘরের
উপাসনা করি না; আমরা একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করি। আর আল্লাহ কেবল এই ঘরে নয়, আল্লাহ
সর্বত্র বিরাজমান’।
ইদানিং আমাদের
আলেমরা ডিজিটাল ছবি, ভিডিওকে জায়েজ বলছেন এই যুক্তিতে যে, এটা সত্যিকারের ছবি নয়। এটা
মূলতঃ অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোর কণা। সেই একই যুক্তিতে প্রিন্টেড ছবিও সত্যিকারের
ছবি নয়। তা মূলতঃ কাগজ এবং কালি। একটা মূর্তি মূলতঃ রঙ করা মাটি এবং পাথরের টুকরা।
সৌদি আরবের
মহাসড়কে ‘খাদেমূল হারামাইন’ বাদশা সালমানের প্রতিকৃতি টাঙ্গানো। সে ছবিকে অবমাননা করলে
জেলে যেতে হবে। দেশে দেশে নরেন্দ্র মোদী, ডোনাল ট্র্যাম্পের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়।
তার মানে, কোনো মানুষের প্রতি সম্মান বা অসম্মান প্রদর্শনের জন্য তার ছবি বা মূর্তিকে
সম্মান বা অপমান করার রেওয়াজ একটা সাধারণ ধারণা।
হিন্দু ধর্মের
খাঁটি অনুশীলনকারীরা যদি শাস্ত্র অনুযায়ী একজন সর্বশক্তিমান ইশ্বরকেই বিশ্বাস করেন,
প্রকৃত ভগবানের উপাসনা করেন আর সৎকর্ম করেন, তবে কোরআন অনুযায়ী তারা কোয়ালিফাইড।
তবে হিন্দু
ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে খুব কম মানুষই হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান রাখেন। এবং
খুব কম মানুষই বিশুদ্ধ সনাতন ধর্ম চর্চা করেন। তারমধ্যে আরো নগন্য যারা সৎকাজ করেন।
কিন্তু সবগুলো কথা মুসলমানদের জন্যও প্রযোজ্য। শিরক, বেদাতমুক্ত বিশুদ্ধ কোরআন অনুসারী
প্রকৃত মুসলমান বেশ দুস্প্রাপ্য। সে প্রকৃত মুসলমানদের মধ্যে সৎকর্মে নিবেদিত মানুষ
প্রায় বিলুপ্ত। কারণ কোরআনে সৎকর্মের যে তালিকা তা বিভিন্ন এনজিওরা করলেও আমরা সেসবকে
ধর্মকর্ম মনে করি না। কিছু পোশাকী রীতি-রেওয়াজকে আমরা ধর্ম হিসাবে মানছি যা কোরআনের
সাথে সম্পর্কেহীন, সামঞ্জস্যহীন বা কোরআন অনুযায়ী গুরুত্বহীন।
বড় বড় দরগাহ,
মাযারে কার্যতঃ যা হচ্ছে তা মূর্তি পুজার মতোই নির্ভেজাল শিরক। আমাদের জন্য আল্লাহর
পক্ষ থেকে নাজিলকৃত সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, অনুমোদিত জীবন বিধান হচ্ছে কোরআন। আজ কোরআনের
সাথে সামঞ্জস্যহীন কথিত এইসব ইজমা, কিয়াস, বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী, দোয়া-তাবিজ নির্ভর
এক উদ্ভট ধর্মচর্চাই ইসলাম নামে পরিচিত।
বেশিরভাগ ধর্মপ্রাণ
মুসলমান এটা উপলব্ধি করতে পর্যন্ত অক্ষম যে, কোরআন আর হাদিসের পার্থক্য কি! কোনটা হাদিসের
কথা, কোনটা কোরআনের কথা তাও অনেকে আলাদা করতে পারে না। আমি নিজে দেখেছি, পবিত্র কোরআনে
সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত কোনো আয়াত থেকে কাউকে কিছু বললে প্রশ্ন করে, ‘এটা কোন হাদিসে আছে’?
আরবী হরফে
ডোনাল ট্রাম্পের বক্তৃতা লিখে দিলেও অনেকে এটাকে কোরানজ্ঞানে সম্মান করবে। দেয়ালে আরবীতে
‘এখানে প্রশ্রাব করা নিষেধ’ লিখে দিলেই মানুষ সেখানে আর পেশাব করে না। একই বাক্য বাংলায়
লেখা থাকলে তা তাকিয়েও দেখে না। মানুষ আরবী লেখা দেখলেই সেটাকে ধর্মের কিছু মনে করে।
মানুষের এই
অন্ধ আবেগকে কাজে লাগিয়ে মুসলমানদের কোরআন থেকে এতো দূরে সরিয়ে নেয়া হয়ছে যে, কতোগুলো
আরবী লেখাকে যাবতীয় সমস্যা সমাধানের দোয়া এবং সেসব দোয়ার কল্পিত ফজিলত সম্পর্কিত বই
আমাদের দৈনন্দিন ধর্মচর্চার প্রধান ভিত্তি।
বেশিরভাগ ধর্মপ্রাণ
মুসলমানকে যদি ইসলাম ধর্মের প্রধান করণীয়, বর্জণীয় কাজগুলোর তালিকা বানাতে বলা হয়,
তারা যে তালিকা বানাবেন তার সিংহভাগই কোরআন বহির্ভূত, কোরআনের বক্তব্যের পরিপন্থী,
মানব রচিত, সংগ্রীহিত, সংকলিত বিভিন্ন কিতাবভিত্তিক।
আমার আগের
দুয়েকটি লেখায় বিস্তারিত বলেছি যে, আমাদের প্রধান প্রধান ধর্মাচারের সাথে কোরআনের সম্পর্ক
কতো দুর্বল! অথচ কোরআনে স্পষ্ট সৎ-অসৎকর্মের নাম আমাদের ধর্মাচারের তালিকায় নেই। কে
কাফের, কে মুশরিক, কে মুনাফেক এ বিতর্কে নামার আগে ‘নিজের পাতলুনের ফিতা আগে ভালো করে
বাঁধুন’।
আল্লাহর নিকট
সবচেয়ে প্রিয় প্রার্থনা হচ্ছে; “ইহদিনাসসিরা-তাল মুসতাকীম” – আমাদেরকে সরল সঠিক পথ
প্রদর্শন করুন। (সরল সঠিক পূণ্য পন্থা দাওগো মোদের বলি)। কারা কারা সঠিক সত্যে অবিচল
তার চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন আল্লাহ।
কোরআন ভিন্ন
ধর্মাবলম্বীদের সাথে ন্যায়সংগত আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। হিন্দু, মুসলমান, ইহূদী,
খৃষ্টান - এসব বিভাজন প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণে।
ধর্মের দোহাই দিয়ে রোহিঙ্গাদের, আসামের মুসলমানদের উৎখাত করা যায়। “জয় শ্রীরাম” শ্লোগান
দিয়ে কাশ্মীরে গণহত্যা চালানো যায়, বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে দেয়া যায় বা আল্লাহু আকবার শ্লোগান
দিয়ে বাংলাদেশের হিন্দুদের উৎখাতের দাবি তোলা আমাদের কাছে জায়েজ(!) মনে হয়।
এসব যারা করেন,
তারা একটুও ভাবেন না; ‘দুয়েকটা ভূখন্ডে কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগুরু
হলেও পৃথিবীর বাকি সব দেশে তারা সংখ্যালঘু। আপনার দেশে আপনি অন্য ধর্মের লোকদের উৎখাতের
শ্লোগান দিচ্ছেন। অথচ আপনার ধ্ররমের লোক যে দেশে সংখ্যালঘু তাদের অধিকারের দাবি তুলছেন।
বেহেশত তো
পরকালের বিষয়। এই দুনিয়াতেই কেউ কাউকে এক চুল পরিমানে ছাড় দিতে নারাজ।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী
বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে যেমন হিন্দু ধর্মের কোনো সম্পর্ক নাই, আল্লাহর
দ্বীন কায়েমের নামে নিরীহ মানুষ হত্যাকারীদের সাথেও ইসলাম ধর্মের কোনো সম্পর্ক নাই।
ইসলামী দলগুলো
যদি কোনো প্রকারে ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে, তবে প্রধান ইসলামী দলগুলোর সম্পর্ক ইসরাইল
ফিলিস্তিনের চেয়েও ভয়াবহ হবে।
ইহূদী, খৃষ্টান,
শিয়া, সুন্নী, হানাফী, হাম্বলী তো বহুদূর, তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপ নিজেদের মধ্যে
মারামারি করে বহুৎ ‘ফায়দা হাসিল’ করছে।
নিজেদেরকে
বেহেশতের সোল এজেন্ট প্রমান করার জন্যই ধর্মের দোকানদাররা মানুষকে বেদ, বাইবেল বা কোরআনের
সরল সত্যের কাছে ভিঁড়তে দেয় না।
(সজল রোশন-এর ভিডিও অবলম্বনে)