গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-৭)

 


বন্ধুদের ভ্রমণের গল্প শোনাতে গিয়ে প্রাসংগিকভাবেই ভ্রমণের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়েরও আলোকপাত করছি। পর্ব-৬ এ চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার মধ্যকার তুলনামূলক ব্যবধান নিয়ে আলাপ করেছিলাম। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এই ব্যবধানের জন্যে দায়ী নয় । দায়ী গোটা সমাজ ব্যবস্থা।

১৯৭১ সালে কল্যানী মুক্তিবাহিনী ট্র্যান্জিট ক্যাম্পে দেখেছি ভারতীয় পুলিশ কিংবা বিএসএফ-এর সদস্যরা লুকিয়ে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের কাছ থেকে জাপানী কেমী অথবা সিটিজেন ঘড়ি কিনতে আসতো। কারণ ভারতীয়রা আগাগোড়াই বিদেশী পন্য ব্যবহারের বিপক্ষে। কেউ দেখে ফেললে তার চাকরির সমস্যা হয় এ ভয় ছিলো। এখনও কোলকাতায় কোনো বিদেশী ব্র্যান্ডের সিগারেট পাওয়া যায় না। কারো চাল-চলনে অতিরঞ্জিত বা অস্বাভাবিক দাম্ভিকতা বা বড়লোকী ভাব প্রকাশ পেলে তার পেছনে গোয়েন্দা লেগে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজে সে কৃষ্টি গড়ে ওঠেনি। এজন্যে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি জনগনও কম দায়ী না।

ভালমন্দ মিলিয়েই মানুষ;- কোনো জায়গা, জেলা বা দেশ আলাদাভাবে কোন ভালো বা মন্দ মানুষ সৃষ্টি বা লালন করেনা। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বত্বায় গড়ে ওঠে। ডাক্তাররাও মানুষ, তাদের মধ্যেও ভালমন্দ মিলিয়েই আছে এবং সেটাও প্রত্যেকের নিজ নিজ ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী। কোন এলাকার মাপকাঠিতে তা বিচার করা উচিৎ না। পর্ব-৬ এর আলোচনায় অনেক বন্ধু ভুল বুঝতে পারেন যে, আমি ঢাকার ডাক্তারদের সুনাম না করে কোলকাতার ডাক্তারদের সুনাম করেছি। আসলে আমি কিন্তু কোন ব্যক্তি বা গোষ্টীর সুনাম বা দুর্নাম করিনি, করেছি সমাজ ব্যবস্থাপনার সমালোচনা।

ভ্রমণ কাহিনী চলতে থাকবে। তবে আজ বাংলাদেশের দু’জন ডাক্তারের ভালমন্দের দিক নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করবো।

সম্ভবতঃ ২০০২ বা ২০০৩ সালের ঘটনা। নারায়ণগঞ্জ পপুলার ডায়গনষ্টিক-এ বসতেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ আবু জাফর। তার একটা সুনাম(!) ছিল, তিনি রোগীদের কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপদেশ দিতেন না। সেজন্যে অনেক রোগী তার কাছে যেতো। একদিন তার কাছে গেলে তিনি এক মাসের একটা ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বললেন, ‘একমাস পরে এসে আবার দেখিয়ে যাবেন’। কথাটি ব্যবস্থাপত্রের উপরেও লিখে দিলেন।

আমাদের দেশের ডাক্তাররা প্রাইভেটভাবে যখন রোগী দেখেন, প্রথমে দেখানোর পর দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের পরামর্শ দিলে সাধারনত; ভিজিট একটু কম রাখেন। কিন্তু ডাঃ আবু জাফরের সহকারী যখন পূরা ভিজিট দাবী করছিলো, আমার একটু সন্দেহ হয়েছিলো য্‌ সহকারীর কোন চালাকি আছে কিনা। বিষয়টা ডাক্তারের কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডাক্তারকে বললাম, ‘আমি আপনার পূরনো রোগী এবং আপনি আসতে পরামর্শ দিয়েছিলেন’।

একথা বলায় তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, ‘তাহলে আর আসতে বলবোনা’। বিষয়টি তিনি সাভাবিকভাবেও বুঝিয়ে দিতে পারতেন।

দ্বিতীয় ঘটনা বেশিদিনের না। মে’ ২০১৩-তে আচমকা পেটব্যাথা শুরু হওয়ায় গেলাম বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের সেরা প্রাইভেট হাসপাতাল ‘মেডিস্টারে’। কিন্তু আজকাল প্রাইভেট হাসপাতালগুলো এক একটি আবাসিক হোটেলের মতো। কো্নো ডাক্তার থাকেনা। কোনো ডাক্তার তার নিজ চেম্বার থেকে কো্নো রোগী পাঠালে সেখানে ভর্তি রাখে এবং নার্স অথবা নতুন পাশ করা কিংবা কোনো ইন্টার্নই ডাক্তার দিয়ে ফলোআপ করায়। মেডিস্টার হাস্পাতালও তার ব্যতিক্রম না।

অতএব, তারা একজন ডাক্তারের নাম বলে সেখানে পাঠিয়ে দিল। ব্যথায় এমন অবস্থা হয়েছিলো যে, রিকশা থেকে জোর করে নেমে রাস্তায় মাটিতে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। ওই অবস্থায়ই আমার স্ত্রী এবং ছেলে কোনমতে ধরাধরি করে নিয়ে গেলো ডাক্তারের চেম্বারে। সেই পপুলার ডায়গনষ্টিকেই বসেন ‘শৈল চিকিৎসক ডাক্তার মোঃ জহিরুল ইসলাম। তিনি দেখে তাড়াতাড়ি পাশের ‘মুক্তি জেনারেল হাসপাতালে’ ভর্তি করালেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা নিলেন।

হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালিন তিনি যখন দেখতে আসতেন তার কথায়ই রোগ অর্ধেক ভালো হয়ে যেতো। মানুষের ৭০% রোগের উৎপত্তিস্থল নাকি মস্তিস্ক। তাকে দেখেছি গল্পের ছলে রোগীর সাথে এক প্রকার পরামর্শ করে চিকিৎসা ব্যাবস্থা দিতে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে তার পরামর্শে আরো দুইবার তার কাছে গিয়েছি। তিনি ৬০% ভিজিট নিয়েছেন।

আমার রোগটি ক্রনিক আকার ধারণ করেছে, তাই মাস দুয়েক পরে আমি যখন নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে স্থায়ীভাবে চলে আসবো, ভাবলাম তার সাথে একটু দেখা করে পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে একটু পরামর্শ নিয়ে যাই। যেভাবে তার কাছে পরামর্শ নিতে যাই তা অন্য কোনো ডাক্তার হলে কি বলতেন জানিনা, কিন্তু তিনি খুব ভালভাবে নিয়েছিলেন।

আমার রোগটি ছিল অগ্নাশয়ে সংক্রমণ(Pancreatitis)। এই রোগের চিকিৎসায় রক্তের ‘Serum Lipase’ পরীক্ষা করাতে হয় এবং তার সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য মাত্রা কতো তা তার কাছে চিকিৎসা নেয়ার সময় তিনিই বুঝিয়েছিলেন(পরীক্ষার ফলপত্রেও উল্যেখ থাকে)। দেখা করতে যাবার আগে নিজ থেকেই সেই পরীক্ষাটি করিয়ে নিয়ে গেলাম। আগে থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে যাওয়ায় অন্যান্য ডাক্তারের মতো বিরক্তি প্রকাশ না করে বরং খুব খুশিই হলেন। তিনি আন্তরিক আলোচনার মাধ্যমে কিছু মৌখিক পরামর্শ এবং একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থাপত্র লিখে নিজের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরটি দিয়ে বললেন, মাঝে মাঝে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে দেখবেন এবং মাত্রা বেড়ে গেলে প্রয়োজন হলে ফোন দেবেন।

বললেও কি তা করা যুক্তিসংগত? তিনি যে সৌজন্যতাটুকু দেখিয়েছেন, এমন যদি সবাই হতো!

দুইমাস পরে নিজ ইচ্ছায় দেখা করতে গেলেও সেদিনের পরামর্শের জন্য তিনি ভিজিট নিয়েছিলেন তার মূল ভিজিটের মাত্র ৪০%। ......(চলবে)।


(২০০৯ সালের ঘটনা। ২০১৪ সালের লেখা)

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url