ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি ধর্মের নামে বাস্তবতা বিবর্জিত মত ও পথ

সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর

অনেকেই আমরা ইসলামের ধর্মীয় বিধান এবং ইসলামের খেলাফতের বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত  ও রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে না পারায় কোরআন, হাদিস ও ফিকাহর পার্থক্য বুঝতে পারি না। এ লেখাটি এই জটিল জট খুলতে সাহায্য করবে। এই লেখায় তুলে ধরবো ‘ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যকার অদৃশ্য দেয়াল নিয়ে। এ বিষয়ে দুটি পয়েন্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো’:

(১)  ইসলামের ধর্মীয় বিধান এবং রাস্ট্র ও খেলাফতের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রণীত আইন যা আমরা ফিকাহ নামে জানি, এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য।

এবং

(২)  ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকতা অর্থৎ যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছেন তারাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রতিবন্ধক।

 

এ বিষয়গুলো ধর্ম সম্পর্কে ন্যুনতম আগ্রহ বা অনাগ্রহ আছে, এমন সবার জানা অপরিহার্য। কারণ দিনশেষে আমরা ধর্মের পক্ষে বা বিপক্ষে কি বলছি আমরা নিজেরাও বুঝি না।

 

অনেকেই প্রশ্ন করেন, নবীজী(সাঃ) কি কোরআনের বাইরে কোনো কথা বলেননি? অবশ্যই বলেছেন। কিন্তু তা কোরআনেরই পুনরাবৃত্তি। সুতরাং কোরআন মানলে হাদীসগুলো মানা হচ্ছেই।

 

কিন্তু একজন রাসুল ছাড়াও ব্যক্তি জীবনে নবীজী(সাঃ) রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান ছিলেন। সে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি কোরআনেই বলা আছে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নবীজী(সাঃ) কোরআনের ভিত্তিতেই নিয়েছেন। তিনি নাগরিকদের প্রত্যাশার ভিত্তিতে সে সময়ের উপযোগী ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান কোরআনের মূলনীতির ভিত্তিতেই প্রণয়ন করেন যা রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য মানা বাধ্যতামূলক ছিলো। কিন্তু তার সবকিছু ধর্মের বিধান নয়।  রাষ্টের সব নাগরিক মুসলিম ছিলেন না। মুসলিমরা এমন অনেক অঞ্চল শাসন করেছে, যেখানে মুসলমানরাই ছিলো সংখ্যালঘু। সম্রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলিম সম্প্রদায়ের আবেগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে রাষ্টের জন্য সার্বজনীন আইন প্রণয়ন করতে হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে নবীজী ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে সেসব আইনের সংযোজন, বিয়োজন, সংশোধনী আসে।

 

উমাইয়া, আব্বাসীয় আমলে আমূল পরিবর্তণ আসে রাষ্ট্রীয় আইনে। কারণ এসময়ে মুসলিম বিশ্বের আকার ও আয়তনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তণ আসে। স্পেনের মতো ইউরোপীয় দেশ মুসলমানরা শাসন করে। সেখানে বাস্তবতার নিরিখেই রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন করা হয়। শারীয়া আইনের গ্রহণযোগ্যতার স্বার্থে শাসকরা এসব আইনের ভিত্তি হিসেবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কোরআন ও হাদিসের রেফারেন্স জুড়ে দেয়। সেসব রাষ্ট্রীয় আইনকেই আমরা বর্তমানে ‘ফিকাহ’ হিসেবে জানি।

 

‘আল্লাহর নির্দেশের বাইরে নবীজী(সাঃ) কিছুই বলেননি বা নবীজীর পুরো জীবন ছিলো কোরআন’ এমন হাদিসের ভিত্তিতে অনেকেই নবীজী(সাঃ)-এর সকল কথা, কাজ, অনুমোদনকেই ওহী বলছেন। কিন্তু এর যৌক্তিক অর্থ দাঁড়ায়, কোরআনের আদেশ নিষেধের বাইরে নবীজী(সাঃ) কোনো ধর্মীয় আদেশ, নিষেধ, উপদেশ বা কাজ করেননি বা করতে বলেননি এবং নবীজীর কথা, কাজ, অনুমোদন কোরআনে সুসংরক্ষিত। কোরআনের পাতায় লেখা আছে; “হে নবীঃ আপনি বলুন” “হে নবীঃ আপনি পড়ুন” “হে নবীঃ তারা আপনাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, আপনি বলুন” “হে নবীঃ আপনি জানিয়ে দিন” “নবীর জন্য এটা করা পাপ হবে না” বা “নবীর জন্য এটা করা উচিৎ হবে না”।

 

“হে নবীঃ আপনি বলুন” এ কথাটা আল্লাহ কোরআনে ৩৩২ বার বলেছেন। সুতরাং নবীজী কি বলেছেন বা করেছেন তা কোরআনেই আছে। পুরো কোরআন আল্লাহ নবীজী(সাঃ)কে দিয়েই বলিয়েছেন। অভাব, প্রাচুর্য, সংকট, সংগ্রাম, জয়-পরাজয়, জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে করণীয়, বর্জণীয়, পরামর্শ, উৎসাহ, সান্ত্বনা, কারণ দর্শানোর নোটিশ সবকিছু আল্লাহ কোরআনের আয়াতের মাধ্যমেই নবীজীকে দিয়েছেন।

 

নবীজীর স্ত্রীদের অন্যত্র বিবাহ, ঘনিষ্ঠ সহচরদের নবীজীর বিনা অনুমতিতে গৃহে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা কোরআনের আয়াতের মাধ্যমেই দেয়া হয়েছে। নবীজীর সব কথাই যদি ওহী হতো তবে একান্ত ঘরোয়া বিধিনিষেধগুলো নবীজী তার স্ত্রী ও সাহাবীদের জানিয়ে দিতে পারতেন। কারণ এ বিধানগুলো ১৫০০ বছর পরের মানুষদের জন্য প্রাসংগিকই নয়। কোরআনে এমন বিধানও আছে যা একমাত্র নবীজীর জন্যই প্রযোজ্য।

“খালিসাতাল্লাকা মিন দূ নিল মু’মিনিনা” - এ বিধান শুধু তোমার জন্য, অন্য মুমিনদের জন্য নয়”-(৩৩:৫০)।

 

যে বিধান মুমিনদের জন্য প্রযোজ্যই নয় তা আল্লাহ কোরআনে অন্তর্ভূক্ত করলেন কেনো? তাছাড়া নবীজীর কোরআন বহির্ভূত সব কথা যদি ওহী হতো তবে তা আল্লাহই কোরআনের মতো সংরক্ষণ করতেন যা নিয়ে কোনো সন্দেহ, সংশয় বা বিতর্কের অবকাশই থাকতো না। নবীজী এবং প্রধান সাহাবীরা যদি হাদিস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ন্যুনতম প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন, সামান্যতম উদ্যোগও নিতেন তবে হাদিস নিয়ে তুঘলকি কাণ্ডকারখানা ঘটতো না।

 

নবীজী(সাঃ) এবং খোলাফায়ে রাশেদীন কোরআনের মূলনীতি অনুযায়ীই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। পরবর্তী প্রায় ১০০০ বছর পৃথিবীতে বিভিন্নভাবে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা টিকে ছিলো। শাসন ব্যবস্থায় ধর্মের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো। ধর্মীয় আচার আনুষ্ঠানিকতা শুধু ধর্ম নয়, ছিলো রাষ্ট্রীয় আইন। একটা রাষ্ট্রের আইন হয় সুনির্দিষ্ট। আইন অমান্য করলে কি কি শাস্তি তা সুনির্দিষ্ট করে লেখা থাকে।

 

ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ ইসলামিক স্কলাররা কোরআনের মূলনীতির মধ্যে নবীজী ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ের বিভিন্ন নথিপত্র, তথ্য প্রামানাদীর ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইনী বিধি-বিধান প্রণয়ন করেন।

 

কোন রাস্তায় কতো স্পীডে গাড়ি চালাতে হবে তা কোনো দেশের সংবিধানে লেখা থাকে না। শুধু আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের নীতিমালা সংবিধানে লেখা থাকে।

 

খোলাফেয়ে রাশেদীনের সময় ও পরবর্তী উমাইয়া, আব্বাসী, ওসমানীয় শাসনামলে মসজিদগুলো ছিলো সরকারী অফিস। মসজিদের ইমাম ছিলো স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা, কালেক্টর বা বিচারপতি। সরকারী কার্যক্রম পরিচালিত হতো মসজিদ থেকে। মসজিদ থেকে সরকারী ফরমান জারি করা হতো। বিচার শালিশ হতো মসজিদেই। মসজিদ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হওয়ায় নিয়মিত বিরতিতে মসজিদে উপস্থিত হওয়া সরকারী বাধ্যবাধকতা ছিলো। গনযোগাযোগের আর কোনো মাধ্যম না থাকায় নাগরিকদের জন্য মসজিদে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও ছিলো। কিন্তু এখনকার মসজিদগুলো ‘টেলিগ্রাম অফিসের’ মতো। এর সাথে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের কোনো সম্পর্ক নাই। মসজিদে উপস্থিতির যে বাধ্যবাধকতা তা কেবলমাত্র ধর্মীয়। কোরআনে প্রচলিত মসজিদ কালচারের ধারণা নাই। কারণ কোরআন শুধু ওসমানী আমল নয়, জুকারবার্গ আমলের জন্যও প্রযোজ্য।

 

ইমামরা যে হাজার হাজার ফিকহ্‌ মাসালা বানিয়েছেন তা মূলতঃ ইসলামী রাষ্টের জন্য প্রযোজ্য বিভিন্ন আইন। এখনকার আধুনিক রাষ্ট্র বিবাহ আইন, পারিবারিক আইন, উত্তরাধিকার আইন সহ বিভিন্ন আইন আছে। কিন্তু বাংলাদেশের আইন এবং পাকিস্তানের আইন ভিন্ন। আমেরিকা, কানাডার আইন হুবহু এক নয়। আমেরিকায় যেখানে ২৫% ট্যাক্স দিতে হয়, কানাডায় ৩০%। কানাডার নাগরিক সুবিধা আমেরিকার চেয়ে বেশি। অতএব, সরকারের দায়ও বেশি। আবার সরকার পরিবর্তণের সাথে সাথে এসব আইনেও পরিবর্তণ আসে।

 

বাংলাদেশ আর আমেরিকার ট্রাফিক, ট্যাক্স, ফেমেলি, ইমিগ্রেশন আইন সম্পূর্ণরূপে আলাদা। কোনো আইনকেই আপনি ভালো বা মন্দ বলতে পারবেন না। আমেরিকার আইন আমেরিকার জন্য ঠিক। বাংলাদেশের আইন বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রণীত।

 

আমাদের কওমী, আলীয়া মাদ্রসায় যে বড় বড় হাদিস ও ফিকাহর কিতাব পড়ানো হয় এগুলো উমাইয়া, আব্বাসীয় সরকারের সময়কার আইন এবং সে আইনের সহযোগী নথি।

 

মানুষ ধর্মকে ঐচ্ছিক মনে করলেও রাষ্ট্রের আইন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কারণ রাষ্ট্রের হাতে থানা পুলিশ আছে, জেল ফাঁসির ব্যবস্থা আছে। এসব ফিকহ্‌ বিধি-বিধান ওই সময়ের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো। তাই আমরা এগুলোকে ইসলামের বিধান মনে করি। কিন্তু এগুলো বেশিরভাগই ‘বিএনপি, আওয়ামীলীগ’ সরকারের মতো দলীয় সরকারের আইন। সরকার চেঞ্জ, আইনও চেঞ্জ।

 

মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের নির্দেশে “ফতোয়া-ই-আলমগীরী” সংকলিত হয় যা ছিলো মূলতঃ তৎকালিন মোঘল সরকারের রাষ্ট্রীয় আইন। “ফতোয়া-ই-আলমগীরী” প্রণয়নের উদ্দেশ্যে আওরঙ্গজেব ৫ শতাধিক মুফতি ও মুহাদ্দিস নিয়োগ দেন। তাদের কয়েক বছরব্যাপী পরিশ্রমের মাধ্যমে “ফতোয়া-ই-আলমগীরী” প্রণীত হয়। এ গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য পরিস্থিতি সাপেক্ষে, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, দাস, যুদ্ধ, সম্পদ, আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক, বিনীময়, কর, অর্থনীতি ও অন্যান্য আইন এবং আইনী নির্দেশনা লিপিবদ্ধ করা হয়। গ্রন্থ প্রণয়নে বুখারী, মুসলিম, ফিকহুল আকবর অর্থাৎ হানাফী মাযহাবের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করা হয়। এবং ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালিন জীবনাচরণের ভিত্তিতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

 

সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের পুত্র আওরঙ্গজেব আলমগীরের শাসনকালে এ “ফতোয়া-ই-আলমগীরী”ই ছিলো রষ্ট্রীয় আইন যা ছিলো রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু এখন হানাফী মাযহাবের অনেক আলেম “ফতোয়া-ই-আলমগীরী”র ভিত্তিতে ফতোয়া দেন। এখানেই হচ্ছে সমস্যাটা। “ফিকহুল আকবর” বা “ফতোয়া-ই-আলমগীরী” ইসলামের ধর্মীয় বিধি-বিধান নয়।

 

বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এর অর্থ এই না যে, বাংলাদেশের আইন ইসলামের বিধান। ৩০০ বছর পর হয়তো কেউ বাংলাদেশের সংবিধান দেখে এটাকে ইসলামী রাষ্ট্র মনে করে বর্তমান আইনকে ইসলামী শারীয়া মনে করতে পারে; যেমনটা আমরা “ফতোয়া-ই-আলমগীরী”কে মনে করছি।

 

মোঘলরা হিন্দু, শিখ, জৈন অধ্যুসিত ভারতবর্ষে শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নীতি অবলম্বন করে। সম্রাট বাবর মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হলেও সাম্রাজ্যের ব্যপক বিস্তার ঘটে আকবরের সময়। আকবরের ধর্মীয় নীতি “দ্বীন-ই-ইলাহী”র ব্যাপারে ইতিহাস পাঠকরা জানেন। আকবর ভারতবর্ষের প্রধান ধর্মগুলোর উপর পান্ডিত্য অর্জন করেন। প্রধান প্রধান ধর্মাবলম্বীদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আকবরের আইনে সকল ধর্মের উপস্থিতি থাকলেও মুসলিম স্কলাররা আকবরের উপর বিরাগভাজন ছিলেন।

 

সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর মুসলিম স্কলারদের সমর্থন পেতে হানাফী, সুন্নী, শারীয়া আইন কার্যকর করেন যা ইরানের শিয়া, সাফাভী, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু, শিখ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের বিদ্রোহী করে তোলে। মোঘলদের বিপরীতে সমর্থন বাড়তে থাকে বৃটিশদের। খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী হলেও বৃটিশদের রাষ্ট্রিয় নীতি ছিলো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’।

 

স্থান, কাল বিবেচনায় নিয়ে হিন্দু ধর্মের তীর্থ ভারতবর্ষে বিস্তীর্ণ মোঘল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন সম্রাট আকবর। আওরঙ্গজেবের কথিত শারীয়া আইন “ফতোয়া-ই-আলমগীরী” সে সম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে।

 

ইমাম আবু হানীফার আইনী সমাধান “ফিকহুল আকবর” তার সমসাময়িক এবং তার পরবর্তী অনেক সরকার গ্রহণ করেছে। “ফতোয়া-ই-আলমগীরী”র মতো পরবর্তীকালের বহু রাষ্ট্রীয় আইনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। মোঘলদের পর বৃটিশরাও “ফতোয়া-ই-আলমগীরীর” অনেক আইনই বলবৎ রেখেছে। বৃটিশ চলে গেলেও সেসব আইনের অনেককিছুই আমাদের দেশে চালু আছে। ইউরোপ, আমেরিকায়ও আছে।

 

যারা আইন বা সংবিধান প্রণয়ন করেন তারা “হাম্বুরাবী” “হিরোডোটাস” “কনফুসিয়াস” “সক্রেটিস”এর সময় থেকে প্রচলিত সম্ভাব্য সকল আইন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। পুরনো আইন আমাদের ভালো সময়োপযোগী আইন বানাতে সহায়তা করে।

 

আইনের অন্যতম প্রধান উৎস ধর্মগ্রন্থ। আমেরিকার আইন প্রণেতারাও ইসলামী আইন পড়েছে। বিষদ গবেষনা করেছে। কিন্তু তারা মোঘল বা আব্বাসীয় আমলের আইন হুবহু বলবৎ রাখেনি। কারণ এখন আব্বাসীয় বা মোঘল আমল নয়। সুতরাং সে আইন এখনকার সময়ের জন্য প্রযোজ্যও নয়। মোঘলরা বা আব্বাসীয়রা এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকলে তাদের আইনেও আমূল পরিবর্তণ আসতো। আওরঙ্গজেবের আগে-পরে “ফতোয়া-ই-আলমগীরীও” রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে বলবৎ ছিলো না। বৃটিশ আমলে বা পাকিস্তান আমলে কোনো আইন আমাদের বাপ-দাদাদের পছন্দ না হলেও তা তাদের মানতে হয়েছে। এখন আবার সে আইন আমাদের পছন্দ হলেও মানা যাচ্ছে না।

 

বৃটিশরা খৃষ্টান ছিলো। এর অর্থ এই নয় যে,  বৃটিশদের আইন খৃষ্টধর্ম। উমাইয়া, আব্বাসীয়, মোঘলরা মুসলমান ছিলো। তাইবলে তাদের প্রণীত আইন ইসলাম ধর্ম নয়। কেউ যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার অর্থ “ইমাম আবু হানীফার” আইন হুবহু প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন; দয়াকরে স্মরণ রাখুন; ‘আপনার গাড়ি ব্যাক গিয়ারে আছে। এক্সেলেটরে চাপ দিলে গাড়ি সামনে যাবে না, যাবে পিছনে’।

 

মানুষের ব্যক্তিগত জীবনাচরণও রাষ্ট্রীয় আইনের উপরে নির্ভর করে। রাষ্ট্র ও সামাজিক আইন মানুষের ব্যক্তিগত আচরণকেও প্রভাবিত করে। মদীনা, কুফা, দামেস্ক সরকারের আইন, এমনকি “ফিকহুল আকবর” “ফতোয়া-ই-আলমগীরী” অনুযায়ী বিয়ে, তালাক ছিলো মৌখিক চুক্তি। কিন্তু এখন খোদ সৌদি, ইরান, পাকিস্তানেও বিয়ে, তালাক রেজিষ্ট্রি করতে হয়। ১০০০ স্বাক্ষী থাকলেও তা আইনত বিয়ে বা বিচ্ছেদ বলে গন্য হবে না। হাদিস হুবহু নিলে তো বিয়ে রেজিষ্ট্রি করাও বেদাত। বর্তমানে নবীজী ক্ষমতায় থাকলে বিয়ে রেজিষ্ট্রি করার বিধানই দিতেন। কমন সেন্স! এখনকার সময়ে তিনি নিশ্চয়ই ঢাল তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে যেতেন না।

 

কোরআনে চিরন্তন নীতিমালা বলা আছে। সে নীতিমালার আলোকে প্রতিটা সমাজ, সরকার বা রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্যে আইন প্রণয়ন করবে এবং সে আইন রাষ্ট্রের প্রতিটা নাগরিককে মেনে চলতে হবে; এটাই কোরআনের বিধান।

“আতী’উল্লা হা ওয়া আতীউররাসুলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম”- তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও তার রাসুলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের আমীরের আনুগত্য করো”-(৪:৫৯)। এ ‘আমীর’ আমির খান বা কওমী হুজুর না। এ আমীর অর্থ নেতা।

 

রাসুল মুমিনদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান ছিলেন। রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান হিসাবে নবীজী(সাঃ) সুনির্দিষ্ট কিছু আইনের বিধান দিয়েছেন যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় অনেক নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের স্বার্থে। একারনেই আহলে হাদীসের কিছু কিছু লোক “খোলাফেয়ে রাশেশেদীনের” খলিফাদেরকেও বেদাতী বলেন।

 

হযরত আলী(রাঃ)’র সময়ে রাজধানী মদীনা থেকে কুফায় স্থানান্তর করা হয়। কারণ হযরত আলী(রাঃ)’র সময়ে মুসলিম বিশ্বের ভৌগলিক আকার, আয়তনে ব্যাপক পরিবর্তণ আসে। কুফা থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা সহজ ছিলো। ধর্মীয় আবেগ বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান সময়ে নবীর শহর মদীনার পরিবর্তে কুফা’কে রাজধানী বানানো কতোজনের সমর্থন পাওয়া যাবে?

 

ইসলাম প্রতিষ্টার নামে যারা আব্বাসীয়, ওসমানীয় বা উমাইয়া প্রশাসনের আইন হুবহু বাস্তবায়ন করতে চান, কিছু পোশাকী রীতি-নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চান তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথকে দূর্গম করে তুলছেন।

ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হিজাব-নিকাব বাধ্যতামূলক করা, ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করা, ভিন্ন মতাবলম্বীদের মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে শিরোচ্ছেদ করাকে যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা মনে করেন তারা ইসলামকে নতুন প্রজন্মের কাছে কঠিন ও দুর্বোধ্য করে তুলছেন। একথাগুলো যারা বলছেন তাদের কোরআনের মৌলিক নীতিমালা সম্পর্কে কোনো ধারণা তো নাইই, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কেও কোনো ধারণা নাই।

 

রাষ্ট্রের গতিশীলতা, দ্রুত পরিবর্তণশীল বিশ্বব্যবস্থায় নাগরিকদের নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ইত্যাদি নিয়ে রাষ্ট্রকে কতো হাজার বিষয় বিবেচনায় নিতে হয় তা আমাদের শায়খুল হাদীসদের কল্পনারও বাইরে। কারণ রাষ্ট্র কিভাবে চলে তা তাদের ‘সিলেবাসেই’ নাই। তাদের সিলেবাসে আছে হাদিসের প্রসিদ্ধ ৬ টি কিতাব এবং ইমাম আবু হানীফার “ফতহুল আকবর” থেকে শুরু করে “ফতোয়া-ই-আলমগীরী” পর্যন্ত ডজনখানেক ফতোয়ার কিতাব। যেগুলোর সাথে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার কোনো সম্পর্কই নাই। এসব ফতোয়া প্রণয়ন ও হাদিস সংগ্রহ করা হয় উমাইয়া, আব্বাসীয় সরকারের প্রণীত আইন ও তার রেফারেন্স হিসাবে।

 

ইমাম আবু হানীফার অনেক বিধান খলিফা আল মনসুরের পছন্দ না হওয়ায় খলিফার রোষালনে পড়ে জীবন দিতে হয়েছে ইমাম আযম আবু হানীফাকে। কিন্তু পরবর্তীতে অনেক খলিফা ইমাম আবু হানীফার অনেক আইনকে কার্যকর করেন। কিন্তু স্বয়ং আবু হানীফা বেঁচে থাকলে “ফিকহুল আকবর” নতুন করে লিখতেন। অথচ আমাদের মুফতি সাহেবরা ১২০০ বছর আগের ইমামদের প্রণীত শারীয়া আইন পড়েন এবং তা হুবহু ‘এক্সিকিউট’ করার দাবী তোলেন। এই হাজার বছরের ব্যবধানে পৃথিবী কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সে হুঁশ আমাদের নাই। তখনকার শারীয়া আইনের সাথে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো যোগসূত্রই নাই।

 

রাষ্ট্র চলছে রাষ্ট্রের মতো। উমাইয়া আমলের শারীয়া আইন পড়ে কি হবে? এসব আইন প্রয়োগ করবে কে? কেনো করবে? রাষ্ট্রতো শারীয়া ভিত্তিক নয়। এমনকি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেও কোরআনের মূলনীতির মধ্যে থেকেই এখনকার প্রয়োজন ও সময়োপযোগী আইন বানাতে হবে। কিন্তু সময়োপযোগী ইসলামী আইন বানানোর সামর্থ আমাদের আলেমদের আছে? সে মানসিকতাই তো নাই। আমরা আছি “ব্যাক গিয়ারে”। মদীনা ইসলামী রাষ্ট্রের খাজনা ও মৌলিক অধিকার কাঠামোর বাইরে আমরা যেতে পারছি না।

 

বাংলাদেশের শায়খুল হাদীস, মুফতিদের হাতে ক্ষমতা দিলে তারা দুইদিনও দেশ চালাতে পারবে না। কারণ দেশ কিভাবে চলে তার ধারণা, অভিজ্ঞতা, ট্রেনিং সর্বোপরি মনোভাবই তাদের নাই। ইসলাম কায়েম করতে চাইলেও আইন বানানোর জন্য ‘ডঃ আসিফ নজরুল’কে লাগবে! দাড়ি, পাগড়ি, পাঞ্জাবী পরিয়ে তাকেই গ্র্যান্ড মুফতি বানাতে হবে। সে আইন প্রণয়ণের জন্য এখনকার সচিব, আইজিপি বা জেনারেলদেরই লাগবে।

 

আপনি বড়জোর একটা প্রজ্ঞাপন জারি করে তাদের ইউনিফরম বদলে দিতে পারবেন যে; ‘এখন থেকে মহিলারা নিকাব আর পুরুষরা পাঞ্জাবী, পাগড়ি পরে সচিবালয়ে আসবেন’! অবশ্য প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে না। তখন কে কার চেয়ে বড় ‘দরবেশ’ তা প্রমাণের জন্য প্রতিযোগিতায় নামবেন আমলারা! সবাই রাতারাতি হুজুরের বেশ ধরবেন! দেখতে মনে হবে হুজুররা দেশ চালাচ্ছে, কিন্তু আসলে তা না। ইরান আফগানিস্তানে দাড়ি, পাগড়ি পরা পদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা কওমী মাদ্রাসার হুজুর না। এরা হাই প্রোফাইল ডিপ্লম্যাট, ইকোনোমিষ্ট ও মিলিটারি জেনারেল। শুধু হুজুরের বেশ ধরা।

 

সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি, মসজিদে নববীর ইমাম- আমাদের হুজুরদের মতো ‘টেলিগ্রাম অফিসের’ কর্মকর্তা না। তারা কার্যত জাতীয় সংসদের স্পীকার বা প্রধান বিচারপতি। শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অনুযায়ীই তাদের এ পদে নিয়োগ দেয়া হয়।

 

“শুধু নামাজের ইমামতি করতে পারলেই প্রধান বিচারপতি হওয়া যায় না। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনও বা এসি ল্যান্ডকে ইমামতি শেখাতে সময় লাগবে না। কিন্তু ইমাম সাহেবকে দিয়ে জেলা চালাতে পারবেন না। উনি নিজেই রিজাইন দিয়ে চলে যাবেন। কারণ ওনার গিয়ার চেঞ্জ করতেই আরো ২০০ বছর লাগবে”।

 

ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেকের মতো স্কলাররা আমাদের মুফতি, মুহাদ্দিসদের মতো ‘নিধিরাম সরদার’ ছিলেন না। তারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ছিলেন। তারা তাদের সময়ের সেরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীও ছিলেন। তারা তখনকার রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থার প্রয়োজনানুযায়ী কোরআনভিত্তিক আইন প্রণয়ন করেছেন। কিন্তু সেসব আইন যারা এখনকার সমাজ ও রাষ্ট্রে অবিকল প্রয়োগ করতে চান; ‘তাদের ধারণাই নাই, তারা কি বলছেন’।

ভাইসাহেব, এখন দ্বিতীয়ার্ধের খেলা চলছে, আগের গোলপোষ্টে বল দিলে তা আত্মঘাতী গোল হবে। এবং এই আত্মঘাতী গোলই দিচ্ছেন আমাদের ‘সুপারস্টাররা’।

 

এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় শারীয়া আইনকে ইসলাম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার কারণেই ইসলাম নতুন প্রজন্মের কাছে ‘গেলার অযোগ্য ঢেঁকি’তে পরিণত হয়েছে। প্রচন্ড ধর্মপ্রাণ মানুষও ধর্মনিরপেক্ষতাকেই বিজ্ঞানসম্মত মনে করে। তারাও ইসলামী দলের ম্যানুফেস্টোতে ভরসা রাখতে পারে না।

 

এসব কথার সাথে আপনাকে একমত হতে হবে বলছি না। কিন্তু সত্যতা যাচাই করতে পারবেন খুব সহজেই। নিজেই বুঝবেন হাদিসের সবকথা নবীজীর নয়। হাদিসের নামে দিনশেষে আমরা মানছি “ভুট্টো সাহেবদের” কথা!!

 

(তথ্য-উপাত্ত যাচাইপূর্বক সজল রোশনের ভিডিও অবলম্বনে)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url