গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-৩)


একটি লোকাল ট্রেন এক ষ্টেশনে মাত্র ১৫ সেকেন্ড বিরতি দেয় অনেকে শুনে হয়তো অবাকই হচ্ছেন। বিষয়টি আমারও বোধগম্যের বাইরে ছিল। ২০০৯-এ কোলকাতা বেড়িয়ে এসে অনুমান নির্ভর একটা সময় ধরে নিয়েছিলাম যে বিরতির সময়টা হয়তো ১ মিনিট হবে। সে ধারণা থেকে অনেকের কাছে গল্পও করেছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল গল্পটা কেউ বিশ্বাস করছে না। সেটা বুঝতে পেরেই আমার মনে একটা খটকা দানা বাঁধে যে, একটা ট্রেন এক ষ্টেশনে মাত্র ১ মিনিট বিরতি কি করে সম্ভব! যেখানে আমাদের দেশে যে কোনো ছোট ষ্টেশনে কমপক্ষে ৫ মিনিট বিরতি দেয়। নাকি ২ মিনিট হবে?

 

সে খটকা থেকেই ২০১০-এ যখন একই রুটে আবার কোলকাতা বেড়াতে যাই, গেদে ষ্টেশন থেকে রানাঘাট পর্যন্ত কয়েকটা ষ্টেশনে ঘড়ি ধরে ট্রেন থামা এবং ছাড়ার সময় পরখ করতে গিয়ে অবাক হতে হলো! কোনো বাতুলতাতো নয়ই, বরং আমার আগের অনুমাননির্ভর সময়ও সঠিক নয়। এক ষ্টেশনে মাত্র ১৫ সেকেন্ড বিরতি দেয়।

 

ট্রেনে যেতে যেতে অনেকের সাথেই আলাপ হলো- গেদে থেকে অনেকেই ট্রেনের ডেইলী প্যাসেঞ্জার হিসেবে কোলকাতায় অফিস করে। তার প্রমাণও পেলাম ২০১০-এ সকালের ট্রেনে যাওয়ার সময়।

 

গেদে বা পরের কয়েকটি ষ্টেশন থেকে যারা কোলকাতায় গিয়ে অফিস করে আবার নিজ বাড়ি ফিরে আসে তারা সাধারণতঃ সকাল ৭টায় রওনা হয়ে ১০টায় কোলকাতা গিয়ে অফিস ধরে। অফিস শেষে বিকেল/সন্ধ্যা ৫/৭টার ট্রেনে কোলকাতা থেকে নিজ বাড়ি ফেরত আসে। অফিস সময়ে ট্রেনের সংখ্যাও বেশি থাকে।

 

‘ঢাকায় এখন উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০-২২ কিলোমিটা্র রাস্তা বাসে সকাল ৭টায় রওনা হয়ে ১০টায় অফিস ধরতে যেখানে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে গেদে থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত ১১৯ কি্লোমিটার ট্রেন জার্নি করে এখনও পশ্চিম বাংলার মানুষ অফিস করে’।

সময়ের সাথে সাথে সভ্যতারও (culture) উন্নতি হচ্ছে এটা সজ্ঞানে বলতে পারি। স্বচক্ষে দেখা একটা সত্য ঘটনা বর্ণনা করবো, এতে পশ্চিম বাংলার বন্ধুরা আশাকরি কিছু মনে করবেন না।

 

১৯৭১ সালে পশ্চিম বাংলায় ১৪/১৫ বছরের মেয়েদেরকে হাফপ্যান্ট পরে রাস্তায় চলাচল করতে দেখা যেতো। ট্রেনে বা বাসে চলাচল করার সময় কাড়াকাড়ি করে সিট দখলে মেয়েরা পিছিয়ে পরতো, তাই সিটে পুরুষদের পাশে সামান্য একটু ফাঁকফোকর দেখলেই মেয়েরা ধপাস করে পুরুষদের প্রায় কোলের উপরে বসে ঠেলেঠুলে জায়গা করার চেষ্টা করতো। ছেলেরাও কিছুটা স্পর্শসুখানুভুতির লোভে অথবা বিব্রতবোধ কিংবা লজ্জায়, কিংবা সহানুভূতির দৃষ্টিতে চেপে জায়গা দিতে বাধ্য হতো। কেউ কেউ আবার সহানুভূতির দৃষ্টিতেই হোক কিংবা বিরক্তিতেই হোক সিট ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়েও যেতো। কিন্তু আজকাল তেমনটি ভাবাও যায়না। ১৪/১৫ বছরের কোনো মেয়ে লোকালয়ে হাফপ্যান্ট পরেও বেরোয়না, ট্রেনে বাসে ধপাস করে কারো কোলের উপরেও বসে পরেনা।

 

১৯৭১ সালে ধর্মীয় কারণে মানুষে মানুষে এক বিরাট ব্যবধান চোখে পরতো। একে অপরের প্রতি বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যে সামাজিক, সাম্প্রদায়িক দূরত্ব লক্ষ্য করা যেতো, বর্তমানে সেটা খুব একটা চোখে পরেনা। না জানি তখন শুধু পশ্চিম বাংলায়ই প্রায় এক কোটি উদবাস্তু বাংলাদেশ থেকে গিয়ে পশভিম বাংলার মানূষদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটার কারণে কিনা?

 

আজকাল (২০১০) কোলকাতার রাস্তায় বেরুলে কে হিন্দু কে মুসলমান, কে বাঙ্গালি কে অবাঙ্গালি এ নিয়ে খুব একটা মাতামাতি দেখা যায়না। তবে বাংলাদেশ থেকে যেসব হিন্দু পরিবার চাপে পড়ে হোক কিংবা ইচ্ছাকৃতই হোক অনেক আগে পশ্চিম বাংলায় পাড়ি জমিয়েছেন, যাদের বাংলাদেশে তেমন আত্মীয়স্বজন এদেশে নাই,- বাংলাদেশ থেকে কেউ গেলে তারা তাদেরকে বিভিন্ন বিদ্রূপাত্মক শব্দবানে জর্জরিত করে। এমন একজনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল ২০০৯ সালে রাত হয়ে যাওয়ায় ধর্মতলা না গিয়ে অনিচ্ছাসত্বেও শিয়ালদহ ষ্টেশনের পাশে অবস্থিত হোটেল ‘ক্যালকাটা লজ’এ এক রাত অবস্থান করার সময়।

***

বন্ধুদের জ্ঞাতার্থেঃ

পড়তে যাতে কারো ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে সেকারণে পর্বগুলি ২০১৪ সালে ফেসবুকের পর্বের মতোই ছোট রাখছি।

 

 

 

 

 

 

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url