গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-১)
ভূমিকাঃ
“২০১৪ সালে খেয়ালের বসে “গরীবের ভ্রমণ বিলাস”
শিরোনামে সম্পূর্ণ নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে জীবনে যেসব জায়গায় গিয়েছি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা
করে ধারাবাহিকভাবে কয়েক পর্বে একটি ভ্রমণ কাহিনী লিখেছিলাম। লেখাটি শিরোনামের মতোই
'নগন্য'। তবে অনেকেই পড়ে উৎসাহ ব্যক্ত করতেন। অনেকে বই আকারে প্রকাশেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কিন্তু যেহেতু আমি লেখক নই, তাই এ সামান্য ঘটনা নিয়ে একটিমাত্র বই ছাপানোর আগ্রহ বা
প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি।
ইদানিং সময় কাটানোর জন্য একটু ব্লগে লেখালেখি করছি। তাই ভাবলাম অন্য লেখার ফাঁকে ফাঁকে
এই লেখাটিও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করি।
তবে আগেই বলে রাখছি, স্বাভাবিকভাবেই এটা কোনো উচ্চভিলাসী বা বিলাসী ভ্রমণ কাহিনী নয়।
আমার মতো নিম্ন আয়ের মানুষ যারা ইচ্ছে থাকলেও বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারেন না।
আবার এমন অনেকেই আছেন যারা নিজ দেশ ছেড়ে পার্শবর্তী দেশেও কোনোদিন যাননি। অনেকের সামর্থ
থাকলেও নানা ঝুট ঝামেলায় যেতে পারেন না। লেখাটি তাদের উদ্দেশ্যেই।
তবে ভালো লাগলে সবাই পড়তে পারেন। ভালো না লাগলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন না। কারণ সবাই
সব বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ না”।
====================
ভ্রমণ করতে কার না ইচ্ছে হয় । মানুষ সুযোগ পেলেই
সাধ্যমত কোথায়ও না কোথায়ও ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। উন্নত দেশের নিম্ন আয়ের লোকেরাও
তাদের উপার্জনের এক তৃতীয়াংশ ব্যয় করে ভ্রমণ খাতে। এমন ক’জন মার্কিন নাগরিকের সাথে
আমার দেখা হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ায়। তাদের সাথে আলাপচারিতায় এ তথ্য বেড়িয়ে আসে।
নেপালে বেড়াতে গিয়েও পরিচয় হয়েছিল কন্যাসম এক
কোরিয়ান মেয়ের সংগে। মেয়েটি স্থাপত্যবিদ্যায় পড়ালেখা শেষ করে চাকরিতে যোগ দেয়ার
আগে একাই বেড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতবর্ষ ভ্রমণে। বললো, 'চাকরিতে যোগ দিলে তো আর
বেড়াতে পারবোনা তাই'।
আমার গ্রামের বাড়ি অজ পাড়াগাঁয়ে এক জংশন রেলওয়ে
ষ্টেশনের প্রায় কাছে। শৈশবে দেখেছি ‘ঢাকা মেইল’ নামে একটি ট্রেন কোলকাতা থেকে
গোয়ালন্দ পর্য্ন্ত সরাসরি যাতায়াত করতো। তখন এক টিকেটেই ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দ
হয়ে ট্রেন ও স্টীমারে কোলকাতা যাতায়াত করা যেতো। আমার জানামতে ঢাকা-কোলকাতা-ঢাকা
যাতায়াতের এটাই ছিল প্রধান রুট। তখন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো উন্নত ছিল না।
ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ(বর্তমানে জেলা) এবং
যশোর জেলার নড়াইল(বর্তমানে জেলা) এলাকার লোকজনও ভাটিয়াপাড়া-কালুখালি রুটের ট্রেনে
এসে কালুখালিতে ট্রেন বদলী করে ‘ঢাকা মেইলে’ পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত তাদের আত্মীয়স্বজন
বাড়িতে বেড়াতে যেতো।
ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি বিশ্বের বৃহত্তম শহর
লন্ডনের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ছিল কোলকাতা। বৃটিশ-ইন্ডিয়ার রাজধানীও ছিল
কোলকাতায়। তাই শৈশবেই কোলকাতা ভ্রমণের একটা আশা মনে পোষণ করছিলাম আর সুযোগের
অপেক্ষায় ছিলাম। ইতোমধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ
সংঘটিত হয় এবং তারপর থেকে ওই ট্রেনটির চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
আমরা তখন ছিলাম পাকিস্তানের একটি অবহেলিত
প্রদেশ। যুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরে দু’টি শত্রুভাবাপন্ন দেশে আর আগের মত যোগাযোগ
অব্যাহত থাকেনি এবং আমার কোলকাতা যাওয়ার স্বপ্নও ভেঙ্গে যায়।
আস্তে আস্তে দিন যায়, আসে ১৯৭১ । মুক্তিযুদ্ধ
শুরুর প্রথম কয়েকদিন অনেক নামী দামী ব্যক্তিদেরকে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেনে
দর্শনা হয়ে ভারতে যেতে দেখেছি। এদের মধ্যে কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমত উল্লাহ এবং তার
ছোট ভাই চিত্রনায়ক জাফর ইকবালও ছিলেন। পরে অবশ্য তারা স্বপক্ষ ত্যাগ করে ভারত থেকে
পাকিস্তান চলে যান। জনশ্রুত আছে শাহনাজ রহমত উল্লাহ্ ও প্রয়াত গজল সম্রাট মেহেদী
হাসান কানেকশনই ছিল এর অন্যতম কারণ।
আমিও মনে মনে সুযোগ খুজছিলাম শৈশবে লালনকৃত আশা
পূর্ণ করার, অর্থাৎ ট্রেনে চেপে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবো। কিন্তু সে আশায়
গুঁড়েবালি। দু’তিন দিনের মধ্যেই ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং ষ্টেশনে পাক-বাহিনী
ক্যাম্প স্থাপন করে। শেষ পর্যন্ত কোলকাতা গিয়েছিলাম ঠিকই তবে ১৫০-১৭৫ কিলোমিটার
রাস্তা ৫ দিন ৫ রাতব্যাপী পায়ে হেঁটে। ফলে আমার স্বপ্নের রাজবাড়ি-দর্শনা-কোলকাতা
রুটে ট্রেনে কোলকাতা যাওয়ার স্বপ্ন- স্বপ্নই থেকে যায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভেবেছিলাম আগের মত ট্রেন
চলাচল শুরু হবে, আগের সেই ঢাকা মেইল আবার চলবে। কিন্তু দেখা গেল পাকিস্তান আমলে,
বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের আগে যে শিথিলতা ছিল যেমন; সরাসরি ট্রেন চলাচল, কোলকাতার
উত্তম-সুচিত্রা জুটির সিনেমা আমদানী ইত্যাদি বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা
পূর্বের সম্পর্ক ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তণের কারণে আর পূন:স্থাপিত হয়নি।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সহায়তা করার কারণে
ভারতের সাথে পাকিস্তানের যে বৈরী সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পরে
বাংলদেশ-ভারতেরও প্রায় একই রকম সম্পর্ক তৈরী হলো। ---(চলবে)