শিশুকালের প্রেম : বিপ্লব কুমার দে

 

বহু বছর আগে থেকেই পৃথিবীর যেকোন বিচারব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছিলাম। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে যে কী হয়, ঘটনাটা পড়লে বুঝতে পারবেন।

 

প্রাইমারিতে পড়তাম ৪৯ নং গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পাশেই ছিলো একটা জুনিয়র হাই স্কুল, দু'টো স্কুলই ছিল কো-এড।

 

সে যাই হোক। ক্লাস থ্রি-তে পড়ার সময় সৌমেন ছিল আমাদের সকলের তুলনায় বেশ লম্বা... বলা যেতে পারে 'অড ম্যান।' ক্লাস থ্রি আর টু-এর মধ্যে কোন দেয়াল ছিল না, ছিল সর্ট পার্টিশন। দুটো পিরিয়ডের মধ্যে বা টিফিনে সুযোগ পেলেই দেখা যেত সৌমেন সেই পার্টিশন টপকে ক্লাস টু-তে। দেবাশিস আবার ছোটখাটো চেহারার হলে কি হবে, একটু এঁচোড়ে পাকা ছিল। সেই প্রথম ক্লাসে রটিয়ে দিল শিহরণ জাগানো ব্রেকিং নিউজ... সৌমেন নাকি ক্লাস টু-র বনানীর সাথে 'লাভ' করে। আর সেই বয়সেই আমরা ইংরেজিতে 'লাইক' আর 'লাভ'-এর মধ্যে যে পার্থক্য তা জেনে গেছি। 

 

শুরু হয়ে গেল আমাদের গোপন আলোচনা। দেবাশিস প্রত্যেকদিন এক একটা নতুন খবর বয়ে আনত। কখন সৌমেন-বনানীকে কথা বলতে দেখা গেছে, কবে টিফিনে সৌমেন বনানীকে আইসক্রিম কিনে খাইয়েছে, কোনদিন বনানী আবার সৌমেনকে জলপাইয়ের আচার খাইয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। টয়লেটে একদিন হঠাৎ দেখা গেল চক দিয়ে সৌমেন+বনানী লেখা। কে লিখেছে তা জানা না গেলেও দেবাশিস জানাল, এটা ওদের 'লাভ'-এর স্বীকৃতি যা সৌমেন নাকি নিজেই লিখেছে। ক্লাসের ডানদিকে ছেলেদের বেঞ্চেই হোক বা বাঁদিকের মেয়েদের বেঞ্চে... আলোচনা তখন একটাই।

 

কিছুদিন এইভাবে চলার পর লক্ষ্য করে দেখলাম এত যে আলোচনা, তার মূলে কিন্তু রয়েছে ঈর্ষা। আমরা কেউই মনে মনে সৌমেনের এই সাফল্য সহ্য করতে পারছি না। তাই কিছুদিনের মধ্যে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বিষয়টা স্যার/দিদিমণিদের জানানো আমাদের জাতীয় কর্তব্য। এর জন্যে আমাদের ক্লাস টিচার  দিদিমণিকেই আমরা বেছে নিলাম কারণ স্কুলে সবচাইতে কড়া দিদিমণি হিসেবে তাঁর বেশ সুনাম ছিল।

 

কিন্তু প্রশ্ন হল, বিড়ালের গলায় ঘন্টা কে বাঁধবে? এক্ষেত্রেও পরিত্রাতা সেই দেবাশিস। পরদিন ফার্স্ট পিরিয়ডে নাম ডাকার পরেই সেই শুভ লগ্ন ধার্য হল।

 

মর্নিং স্কুল। সক্কাল সক্কাল স্কুলে হাজির। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি অভিযোগ পাওয়ার পর দিদিমণি সৌমেনের কি করুণ অবস্থাই না করছেন। কেউ কেউ বলছে, ক্লাস টুতে বনানীর কপালেও দুর্ভোগ আছে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দিদিমণি চলে এলেন ক্লাসে। নাম ডাকা শুরু হল। আমাদের উত্তেজনার পারদ তখন চরমে। দেবাশিসের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি তার মত ডেয়ারিং মালও যে বেশ চাপে আছে, তা বোঝাই যাচ্ছে। 

 

নাম ডাকা শেষ হতেই আচমকা দেবাশিস বেঞ্চ থেকে উঠে বেরিয়ে একেবারে দিদিমণির টেবিলের সামনে। দিদিমণি প্রশ্নসূচক মুখ নিয়ে তাকানোর সাথে সাথে তার অভিযোগ, "দিদিমণি, সৌমেন না...টু-এর বনানীর সাথে লাভ করে।" আমাদের সকলের হৃদস্পন্দন কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ। ক্লাসে চরম নিস্তব্ধতা। তারপরেই দিদিমণির হুঙ্কার, "চুউউউপ, একদম চুপ! ভারি অসভ্য হয়েছ। যাও ওই কোনে গিয়ে নিলডাউন হয়ে বসে থাকো।"

 

আমাদের চোখে তখন পৃথিবীর বিস্ময়। এটা কি হল! দোষ করল সৌমেন, আর সেই দোষ ধরিয়ে দিতে গেল যে, তার হল শাস্তি! এ কেমন বিচার? বেচারা দেবাশিস!

 

সেইদিন থেকে অনাচারে ভরা এই পৃথিবীর সমস্ত বিচার ব্যবস্থার ওপর থেকেই যেন ভরসা উঠে গেল। এক চূড়ান্ত সত্যিতে আমার ঘোর বিশ্বাস জন্মে গেল যে এই জগতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছ কি মরেছ।

 

লেখক: বিপ্লব কুমার দে

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url