হিকমা বা প্রজ্ঞাঃ কি বলার কথা কি বলছি

নবীর প্রজ্ঞা ও জীবনাদর্শকে আমরা আমাদের নিজেদের সুবিধা, পছন্দ ও দলীয় আলেমদের মত অনুযায়ীই বুঝি।আমরা আসলে কোরআন হাদীস নয়, আমাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করি!

 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন;-

“তোমাদের জন্য তোমাদের রাসুলের মধ্যেই আছে উত্তম আদর্শ”-(৩৩:২১)।

নবীজী(সাঃ)-কে আল্লাহ হিকমা দিয়েছেন। কোরআন, হাদীস, সীরাত, ইসলামের ইতিহাসে নবীর উত্তম আদর্শ ও হিকমার বিবরণ আছে।

 

আমাদের শায়খুল হাদীসরা দাবী করছেন, হিকমা হচ্ছে হাদীস। ‘হাদীসে হিকমার বিবরণ আছে, তবে হাদীসকে হিকমা মনে করা নেহায়েত মুর্খতা’।

 

হিকমা মানে প্রজ্ঞা বা ‘উইসডোম’। বিশ্লেষণী ক্ষমতা, শোনার সক্ষমতা বা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। 

 

প্রতিটা জনপদে আল্লাহ নবী পাঠিয়েছেন। প্রতিটা জনপদের প্রজ্ঞাবান মানুষদের আল্লাহ নবী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। যারা মানুষকে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, যুদ্ধ, রাজনীতি, জীবন-জীবিকার মূলনীতি শিক্ষা দিয়েছেন।

 

পৃথিবীতে আর কোনো নবী না এলেও প্রজ্ঞাবান মানূষ আসবে, যারা মানবজাতির জন্য সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির নতুন নতুন দূয়ার খুলবে। এসব জ্ঞানী আর প্রজ্ঞাবান মানুষরাই নবীদের উত্তরসূরী। যারা হবেন সমগ্র মানবজাতির জন্য বাতিঘর। কিন্তু আমরা মদীনা, আল-আযহারে পড়ুয়া শায়খুল হাদীসদের আলেম বা জ্ঞানী মনে করি। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ডে পড়ুয়াদের আলেম মনে করি না। বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সমরবিদ, পদার্থবিদ, চিকিৎসা বিজ্ঞানী,- এরা কি তবে জাহেল বা মুর্খ?

 

জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যারা অবদান রেখে চলেছেন তাদের আমরা বলি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। তাই সেসব শিক্ষার সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নাই। আর মদীনা, আল-আযহার থেকে যারা অসাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বা কথিত আলেমরা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন; মৌছ কদ্দুর বড় হবে? মহিলাদের মুখ খোলা রাখা যাবে কিনা? কিভাবে পানি পান করতে হবে? কোন দোয়া পড়লে বেহেশতের ৮ টি দরজা খুলে দেয়া হবে? দোজখের আগুন হারাম হয়ে যাবে বা “মুজতাজাব উদ দাওয়া” বনে যাবে? ইমাম মাহদি কোথায় আত্মপ্রকাশ করবে?

 

কোরআন, হাদীস, সীরাত, ইসলামের ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অমূল্য রত্নভান্ডার পায়ে ঠেলে হিকমার নামে সব অর্থহীন, অবান্তর, অযৌক্তিক, অসার আলোচনায় কেনো ডুবে থাকি? কারণ আল্লাহ নবীকে দিয়েছেন হিকমা আর আমাদের দিয়েছেন আহাম্মকী।

 

আমেরিকান যোগাযোগবিদ ‘ওয়াল্টার লিপ্পম্যান’ বলেছেন, “প্রজ্ঞা বুঝতে হলেও একজন মানুষের প্রজ্ঞা থাকতে হয়”। “শ্রোতারা বধির হলে সংগীত কিছুই নয়”।

“It requires wisdom to understand wisdom”। “The music is nothing if the audience is deaf”।

একজন বধির মানুষকে মাইকেল জ্যাকশনের গান শোনানো আর ড: মাহফুজুর রহমানের গান শোনানো একই কথা।

 

আমাদের মতো আহাম্মকদের কাছে নবীর হিকমা আর আবু জাহেলের হিকমার তফাৎ নাই। আবু জাহেলরা যা যা করতো, ঠিক একই কাজ আমরা মানছি নবীর সুন্নাহ নাম দিয়ে। আমরা নিজেরা কোরআন, হাদীস, সীরাত, ইতিহাস পড়তে আগ্রহী নই। চিন্তা, গবেষণা করতে রাজী নই। আমরা পালের ভেড়া হয়ে থাকতেই পছন্দ করি। কারণ, এতোগুলো ভেড়া তো ভুল হতে পারে না!

 

হিকমা নাম দিয়ে হাদীসকে কোরানের সমকক্ষ বানিয়ে হাদীসের ভিত্তিতে ধর্মের বিধিবিধান প্রণয়ন করা হচ্ছে।

 

হাদীসে নবীজীর প্রজ্ঞা এবং কোরআনের বাড়তি তথ্যও আছে। সীরাত ও ইতিহাসের কিতাবেও নবীজীর প্রজ্ঞা ও অনুকরণীয় আদর্শ আছে।

 

এই লেখায় নবীজীর হিকমা ও আমাদের আহাম্মকির তুলনামুলক আলোচনা করবো।

 

সকল নবীদের আল্লাহ প্রজ্ঞা দিয়েছেন এবং নবীরাই আমাদের জন্য অনুমোদিত আদর্শ। কোরআনে আল্লাহ নবীদের প্রজ্ঞা ও উত্তম আদর্শের বিবরণ দিয়েছেন। সুরা নূহ, সুরা ইউনুছ, সুরা ইউসুফ, সুরা মোহাম্মদ, সুরা হুদ, সুরা মরিয়ম, সুরা আম্বিয়া, সুরা আহযাব, - কোরআনের পাতায় পাতায় নবীদের জীবনালেখ্য।

 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন;-

 

“ইব্রাহীম ও তার সাথীদের মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ”-(৬০:৪)।

এখন ইব্রাহীম (আঃ)-এর আদর্শ আমরা কোথা থেকে জানবো? সহীহ ইব্রাহীম শরীফ কোন প্রকাশনী প্রকাশ করে?

 

কোরআনে একটা সুরা আছে, সুরা ইব্রাহীম। কোরআনের ৩০ পারার প্রায় ১ পারা জুড়ে শুধু ইব্রাহীম (আঃ)-এর প্রজ্ঞা ও জীবনাদর্শ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইব্রাহীম(আঃ)-এর আপন পিতা, একেবারে ব্যক্তিগত পিতা একজন সার্টিফায়েড মুশরিক। ইব্রাহীম(আঃ)-এর পিতা একজন মুশরিক ছিলেন। নূহ(আঃ)-এর আপন পূত্র ছিলো একজন কাফের। একথা কোরআনে বলার উদ্দেশ্য কি? ‘আল্লাহর কিতাবের বাইরে নবীর বাপের কথাও বিশ্বাস করবে না। আওলাদে রাসুল শুনলেই দৌড় দেবে না। নবীর বাপও মুশরিক হতে পারে, আওলাদে রাসুলও কাফের হতে পারে’।

 

আল্লাহ রাসুলদের অথোরাইজ করেছেন। এর বাইরে যাদেরকে সত্যায়িত করেননি তাদের বক্তব্য গ্রহণের মানদন্ড হবে কোরআন। ইবারহীম(আঃ)কে ফেরেশতারা কিভাবে সালাম দিয়েছেন, তিনি কিভাবে সালামের জবাব দিয়েছেন, কোরআনে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন। “ফেরশ্তারা বললো সালাম” “ইব্রাহীমও বললো সালাম”।

 

অনেকেই শুধু সালাম বললে প্রশ্ন তোলেন, ‘এটা আবার কোন দেশি সালাম’? ‘এটা ইব্রাহীম(আঃ)-এর সালাম’।

 

অনেকেই সালামুন আলায়কুম বলে সালাম দেন। কারণ, কোরআনে সালামুন আলায়কুম বলে সালাম দিতে বলা হয়েছে। সালামুন আলায়কুম একশত ভাগ কোরআন সম্মত সালাম। কিন্তু অনেকে আসসালামু আলায়কুম বলাটাকে কোরআন অস্বীকার করার অভিযোগে কুফরী বলছেন। আবার সালামুন আলায়কুম বললে অনেকে আহলে কোরআন ফেৎনা বলে গালাগালি করেন। এ বিবাদের প্রধান কারণ, আমরা আপাদমস্তক আহাম্মক। আমরা দিনভর পীরের পিছনে দৌড়াই, কিন্তু কোরআন খুলে মিলিয়ে দেখি না।

সালামুন আলাইকুম আর আসসালামু আলাইকুম, এই দুয়ের মধ্যে অর্থ, ভাষা ও ব্যকরণগত কোনো পার্থক্য নাই। কোরআন আর আল-কোরআন একই কথা। তদুপরি কোরআনে নবীরা আসসালামু আলাইকুম বলেও সালাম দিয়েছেন।

 

মুসা(আঃ) এবং হারুণ(আঃ) সালাম দিয়েছেন, “আসসালামু আলা মান’ইত্তাবাল হুদা” সালামুন আলা মান’ইত্তাবাল হুদা বলে নয়। ঈশা(আঃ) সালাম দিয়েছেন, “আসসালামু আলাইয়া” সালামুন আলাইয়া বলে নয়। সুতরাং, সালাম, সালামুন আলাইকুম, আসসালামু আলাইকুম সবই কোরআন এবং হাদীস সম্মত সালাম।

সালাম মানে মুখে একটা মুখস্থ বাক্য বলা নয়। আন্তরিকভাবে তার শান্তি কামনা। অর্থাৎ পরিচিত, অপরিচিত সাবার শান্তি কামনা, মংগল কামনা করা একজন আদর্শ মুসলমানের বৈশিষ্ট।

 

শান্তি বলতে সব রকম শান্তি এবং প্রশান্তি বোঝায়। অর্থাৎ একজন ভালো মুসলমান পরিচিত, অপরিচিত সকলের প্রশান্তি ও আনন্দের কারণ হবে। সকলের শুভাকাংখী হবে, সহযোগী হবে। মানুষকে ভালো কথা বলবে। উৎসাহব্যাঞ্জক, প্রশংসাসূচক কথা বলবে। সালামের জবাবও সালাম। অর্থাৎ আপনার জন্যও প্রশান্তি।

কিন্তু আমরা কারো সালামের জবাব দেই; “আপনার তো সালামই হয় না! আগে সালাম দেয়া শেখেন তারপর কথা বলেন। সালাম দিতে জানে না আবার উপদেশমূলক কথা লেখে”।

 

ইব্রাহীম(আঃ) আল্লাহর কাছে প্রজ্ঞাপূর্ণ দোয়া করেছেন, আল্লাহ কোরআনে তা উল্লেখ করেছেন।

 

“রাব্বি হাবলী হুকমাওঁ ওয়া আল হিকনী বিসসা-লিহীন”। “ওয়াজ’আললী লিছা-না সিদকিন ফিল আ-খিরীন”।

                                                      অর্থ

“হে আমার রাব্ব! আমাকে প্রজ্ঞা দান করুন এবং সৎ কর্মপরায়ণদের সাথে আমাকে মিলিত করুন। আমাকে পরবর্তীদের মাঝে আমার সুনাম, সুখ্যাতি অব্যাহত রাখুন”-(২৬:৮৩-৮৪)

 

ইব্রাহীম(আঃ)-এর আরো দোয়া আছে কোরআনে। ইব্রাহীম(আঃ) আল্লাহর কাছে কি ভিক্ষা চাইতেন? প্রজ্ঞা বা ‘উইসডোম’। তিনি সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভূক্ত থাকার আর্জি পেশ করেছেন।

 

আমল মানে কর্ম। আমাদের কর্ম দুনিয়া, আখেরাতে আমাদের সাফল্য নির্ধারণ করবে। এ আমল মানে মুখস্থ দোয়া দরুদ নয়। সৎকর্ম মানে ভালো কাজ।

 

ইব্রাহীম(আঃ)-এর আবেদনপত্র বলছে, তার কাছে গুরুত্বপূর্ন ছিলো প্রজ্ঞা, সৎকর্ম এবং পরবর্তিদের মধ্যে সুনাম, সুখ্যাতি। কিন্তু আমরা ইব্রাহীম(আঃ)-এর জীবনাদর্শ বলতে বুঝি, ‘সুন্নতে খাৎনা’। এ খৎনার নাম দিয়েছি আমরা  মুসলমানি। মুসলিম আর অমুসলিমদের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে খৎনা।

 

হযরত ইব্রাহীম(আঃ)-এর খৎনার কথা পবিত্র কোরআনে নাই। কোরআনে ৬৯ বার হযরত ইব্রাহীম(আঃ)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম(আঃ)-এর ক্কাবাঘর নির্মাণ এবং অন্য সকল ব্যাপারে কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ তাকে তার গোপন অংগের একটি অংশ কেটে ফেলতে বলা হয়েছে তা কোথাও বলা হয়নি। আল্লাহর উপর হযরত ইবারহীম(আঃ)-এর বিশ্বাস ও নিষ্ঠার কথাই গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে যা আমাদের জন্য অনুকরণিয়।

কিন্তু আমাদের কাছে খৎনা কেনো মুসলমানের সমার্থক? কারণ, আল্লাহ ইব্রাহীম)আঃ) কে দিয়েছেন হিকমা এবং আমাদেরকে দিয়েছেন আহাম্মকি।

 

আমাদের নবীজীর প্রজ্ঞা ও জীবনাদর্শের নির্ভুল বিবরণ একমাত্র কোরআনেই আছে। কোরআনে “সুরা মোহাম্মদ” নামে একটা সুরা আছে। “সুরা আহযাবে” নবীজীর একান্ত ব্যক্তিগত ঘরোয়া বিষয়াদি আলোচিত হয়েছে। এছাড়া কোরআনের বিধিনিষেধ সংক্রান্ত আয়াতগুলো আল্লাহ নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “হে নবী আপনি বলুন” “হে নবী আপনি পড়ুন” “হে নবী আপনি জানিয়ে দিন” “তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি বলুন” “আপনি করুন” “আপনি করবেন না” “নবীর জন্য এটা করা পাপ হবে না” “নবীর জন্য এটা করা উচিৎ হবে না”- কোরআন নবীজীর জীবনালেখ্য।

 

নবীজী(সাঃ)-এর দাড়ি ছিলো বা তাকে দাড়ি রাখার নির্দেশ কোরআনে দেয়া হয়নি। কিন্তু আমাদের কাছে নবীর প্রধান অনুকরণিয় আদর্শ হচ্ছে “দাড়ি”। কারণ, আল্লাহ নবীকে দিয়েছেন হিকমা আর আমাদের দিয়েছেন আহাম্মকি।

 

নবীজী(সাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করছেন। তার প্রচন্ড মন খারাপ। এর আগে তিনি তায়েফে গিয়েছেন। তায়েফবাসীরা তাকে পাথর মেরেছে। মদীনাবাসী বিশ্বাসঘাতকতা করলে তার আর যাওয়ার জায়গা নাই। আল্লাহ নবীজীকে দোয়া শিখিয়ে দিচ্ছেন যে, হে নবী, আপনি আমার কাচ্ছে এই দোয়াটা করুন;-

 

“রাব্বি আদখিলনী মুদ খালা সিদকিওঁ ওয়া আখরিজনী মুখরাজা সিদকিওঁ ওয়াজ‘আলনী মিল্লাদুনকা ছুলতা-নান নাসীরা-“।

                                                      অর্থ

“হে আমার রাব্ব! যেখানে গমন শুভ ও সন্তোষজনক আপনি আমাকে সেখানে নিয়ে যান এবং যেখান হতে নির্গমন শুভ ও সন্তোষজনক সেখান হতে আমাকে বের করে নিন এবং আপনার নিকট হতে আমাকে দান করুন সাহায্যকারী শক্তি”-(১৭:৮০)।

 

এ দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ নবীজীকে মদীনার বাদশা বানিয়েছেন। সমগ্র মদীনাবাসীকে আল্লাহ আনসার-সাহায্যকারী বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোরআনের ‘রেডিমেড’ দোয়া আমাদের মনপুতঃ হয় না। আবু হুরাইজা থেকে আবু কুরাইজা। তার থেকে আবু নুসাইবা - এভাবে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে একটা সহীহ দোয়া খুজে বের করি। আর কোরআনের পাতায় আল্লাহ নবী-রাসুলদের তাৎপর্যপূর্ণ দোয়া বর্ণনা করেছেন তা আমাদের পর্যাপ্ত মনে হয় না।

 

হযরত আদম(আঃ) আল্লাহর আদেশ অমান্য করে যখন আল্লাহর বিরাগভাজন হলেন, তিনি কাঁদতে কাঁদতে পেরেসান হয়ে গেলেন। কোনো দোয়ায় কোনো কাজ হয় না। শেষে যে দোয়ায় আরশে আযীমের দূয়ার খুলেছে সে পাসওয়ার্ড আল্লাহ কোরআনে বলে দিয়েছেন।

 

আল্লাহ বলেন, আমি আদম ও হাওয়াকে তখন ক্ষমা করেছি, যখন তারা বললো;-

 

“রাব্বানা-জালামনাআনফুছানা-ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা-ওয়া তারহামনা-লানাকূনান্না মিনাল খা-ছিরীন”।

                                                      অর্থ

“হে আমাদের রাব্ব! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব”-(৭:২৩)।

 

হযরত নূহ(আঃ) আল্লাহর কাছে কি দোয়া করতেন? আল্লাহ নিজেই বর্ণনা করেছেন। কোনো ভায়া মিডিয়া নাই। সুরা “হুদ” এর ৪৭ নং আয়াতে আল্লাহ আমাদের শেখাচ্ছেন হযরত নূহ(আঃ)-এর দোয়া। সে বললো;-

 

“রাব্বি ইন্নীআঊযুবিকা আন আছআলাকা মা-লাইছা লী বিহী ‘ইলমুওঁ ওয়া ইল্লাতাগফিরলী ওয়া তারহামনী আকুম মিনাল খা-ছিরীন”।

                                                      অর্থ

“হে আমার রাব্ব! আমি আপনার নিকট এমন বিষয়ের আবেদন করা হতে আশ্রয় চাচ্ছি যে সম্বন্ধে আমার জ্ঞান নেই, আর আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন তাহলে আমি সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে যাব”-(১১:৪৭)।

 

নূহ(আঃ)-এর মতো এতো মর্যাদাবান নবী, যার নামে কোরানে একটা সুরা আছে, “সুরা নূহ”। তিনি জানতেন যে তিনি সব বিষয়ে জানেন না। আর আমরা নিজেদের আল্লামা দাবি করি। আল্লামা শব্দের অর্থ সর্বোজ্ঞ। এটা আল্লাহর উপাধি।

 

হযরত যাকারিয়া (আঃ)-এর সন্তান হয় না। তো তিনি কোন দরগায় মানত করলেন? আল্লাহ বলে দিচ্ছেন;-

 

“হুনা-লিকা দা’আ- ঝাকারিইইয়া-রাব্বাহূ  কা-লা রাব্বি হাবলী মিল্লাদুনকা যুররিইইয়াতান তাইয়িবাতান ইন্নাকা ছামী’উদ্দু’আই”।

                                                      অর্থ

“তখন যাকারিয়া তার রবের নিকট প্রার্থনা করেছিল, সে বলেছিলঃ হে আমার রাব্ব! আমাকে আপনার নিকট হতে পবিত্র সন্তান প্রদান করুন, নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী”-(৩:৩৮)।

 

এ দোয়ার পর কি ঘটলো সেটাও আল্লাহ কোরআনে বলে দিয়েছেন। এ দোয়ার পর আল্লাহ তাকে একটি পুত্র সন্তান দান করেছেন। যেনতেন পুত্র সন্তান নয়। আল্লাহর আরেক পয়গম্বর হযরত ইয়াহিয়া(আঃ)।

 

হযরত মুসা (আঃ)কে আল্লাহ কিতাব দিয়ে বললেন, আপনি আমার কিতাব প্রচার করেন। মুসা (আঃ)-এর হাঁটু কাঁপা শুরু হয়ে গেলো। কারণ, তিনি ভালো করেই জানেন যে, আল্লাহর কিতাবের কথা বললেই এই ফেরাউনের দল তাকে “আহলে কোরান” “মুতাজিলা” “মুনকারিনে হাদীস” “ ওরিয়েন্টালিষ্ট” “আমেরিকার দালাল” বলে ধাওয়া দেবে! তখন তিনি আল্লাহর কাছে বসে প্রার্থনা করলেন;-

 

“রাব্বিশরাহলী সাদরী। ওয়া ইয়াছছিরলীআমরী। ওয়াহলুল ‘উকদাতাম মিলিলছা-নী। ইয়াফকাহূকাওলী”।

                                                      অর্থ

“হে আমার রাব্ব! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন। আমার কাজকে সহজ করে দিন। আমার জিহবার জড়তা দূর করে দিন। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে”-(২০:২৫-২৮)।

 

এই কথাটাকে ভাবানুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;-

 

“অন্তর মম বিকশিত করো, অন্তরতর হে,

নির্মল করো উজ্জ্বল করো সুন্দর করো হে।

জাগ্রত করো, উদ্যত করো নির্ভয় করো হে,

মঙ্গল করো, নিরলস নিঃশংসয় করো হে”।

 

এ কবিতার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আর আমাদের গবেষণার বিষয়, মুসা(আঃ) তার ভাই হারুণ(আঃ)-এর চুল ও দাড়ি ধরে টেনেছেন। অর্থাৎ হারুণ(আঃ)-এর দাড়ি ছিলো। সুতরাং দাড়ি রাখার কথা কোরানে আছে। যদিও এই যুক্তিতে চুল রাখা ফরয হয়নি। কারণ, মুসা(আঃ)কে আল্লাহ দিয়েচ্ছেন হিকমা আর আমাদের দিয়েছেন আহাম্মকি।

 

হযরত আইউব(আঃ)কে আল্লাহ ধুলায় মিশিয়ে দিলেন। তার সম্মান, সম্পদ, সন্তান, স্বাস্থ্য – সবকিছু আল্লাহ নিয়ে গেছেন। শুধু নিঃশ্বাসটুকু ছিলো। তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। কোরআনের সুরা ২১, আয়াত ৮৩।

 

“ওয়া আইঁয়ুবা ইযনা-দা-রাব্বাহূআন্নী মাছছানিয়াদদু ররু ওয়া আনতা আরহামুররা-হিমীন”।

                                                      অর্থ

“আর স্মরণ কর আইয়ুবের কথা, যখন সে তার রাব্বকে আহবান করে বলেছিলঃ আমি দুঃখ কষ্টে পতিত হয়েছি, আপনিতো দয়ালুদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু”-(২১:৮৩)।

 

হযরত আইউব(আঃ)-এর এ দোয়ায় আল্লাহ লজ্জিত হয়ে গেলেন এবং তাকে  তার সবকিছু আবার ফিরিয়ে দিলেন।

 

আবার হযরত সোলাইমান(আঃ)কে আল্লাহ এমন বাদশাহী দিলেন, তিনি নবীর ছেলে নবী, বাদশার ছেলে বাদশা। সমস্ত সৃষ্টিকূলের উপর আল্লাহ তাকে কতৃত্ব দিয়েছেন। মানূষ, জ্বীন, ডাইনোসরের মতো প্রকান্ড প্রকান্ড প্রাণী নিয়ে হযরত সোলাইমান(আঃ)-এর আর্মি। এ প্রতাপশালী আর্মি যখন দুনিয়া কাঁপিয়ে মার্চ করছিলো, তখন একটি পিঁপড়া বললো, “সোলাইমানের আর্মি আসছে, ভাগ। পায়ের নিচে পড়ে মরবি”। হযরত সোলাইমান(আঃ) পিঁপড়ার একথাটা শুনেছেন। এই পিঁপড়ার জন্য তিনি তার আর্মি হল্ট করলেন।

 

আজব দুনিয়া, গজব কাহিনী বলছি না। কোরআনের কাহিনী বলছি। কোরআনে একটা সুরা আছে, “সুরা নামল”। এই নামল শব্দের অর্থ পিঁপড়া। যেনতেন পিঁপড়া নয়, যে পিঁপড়ার জন্য বাদশা সোলাইমান তার আর্মি হল্ট করেছেন।

সেখানে বসে হযরত সোলাইমান(আঃ) অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এক দোয়া করলেন। সুরা নামলের ১৯ নং আয়াত;-

 

“রাব্বি আওঝি’নীআন আশকুরা নি’মাতাকাল্লাতীআন’আমতা ‘আলাইইয়া ওয়া ‘আলা-ওয়া-লিদাইইয়া ওয়াআন আ‘মালা সালিহান তারদা-হু ওয়া আদখিলনী বিরাহমাতিকা ফী ‘ইবাদিকাসসা-লিহীন”।

                                                      অর্থ

“হে আমার রাব্ব! আপনি আমাকে সামর্থ্য দিন যাতে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, আমার প্রতি ও আমার মাতা-পিতার প্রতি আপনি যে অনুগ্রহ করেছেন তজ্জন্য এবং যাতে আমি সৎ কাজ করতে পারি, যা আপনি পছন্দ করেন এবং আপনার অনুগ্রহে আমাকে আপনার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের শ্রেণীভুক্ত করুন”-(২৭:১৯)।

 

এই কথাগুলোকে ভাবানুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর;-

 

“আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে,

সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।

আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে,

তোমারই ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবন মাঝে।

আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয় পদ্মদলে,

সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে”।।

 

খেয়াল করুন, আল্লাহ নবীদের জীবনাদর্শের মাধ্যমে আমাদের কি শিক্ষা দিচ্ছেন। যে, আইউবের মতো ধুলায় মিশে গেলেও হিম্মত হারাবে না, বিশ্বাস হারাবে না। আবার সোলাইমানের মতো বাদশা হলেও একটা পিঁপড়াকে নগন্য আন্দাজ করবে না।

 

সোলাইমান(আঃ)-এর মতো বাদশা হলে পিঁপড়া তো পিঁপড়া, এই দুনিয়াটাকে আমাদের কাছে টেনিস বলের মতো মনে হবে।

 

দুঃসময়ে ধৈর্যধারণ করা কঠিন, কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় কঠিন সুসময়ে বিনয়াবনত থাকা। শক্তির একটা নিজস্ব ধর্ম আছে। আপনার কাছে যখন অর্থ, খ্যাতি বা ক্ষমতা থাকবে তখন আপনি বুঝবেন নিস্কলুষ, নিরহংকার থাকা কতো কঠিন।

 

আমরা অহংকার করি না, কারণ আমাদের অহংকার করার মতো কিছু নাই। পৃথিবীতে অহংকারী হওয়ার সবচেয়ে বেশি সুযোগ ছিলো সোলাইমান(আঃ)-এর। তিনি দুনিয়ায়ও বাদশা, আখেরাতেও বাদশা। সোলাইমান (আঃ)-এর মতো বাদশাহী আল্লাহ ফেরাউনকেও দিয়েছিলেন। কিন্তু ফেরাউন শুকরিয়া আদায় করা তো দূরের কথা নিজেকেই খোদা দাবি করেছেন। আল্লাহ তাকে দুনিয়াবাসীর সামনে অপদস্ত করেছেন।

 

নবীরা আল্লাহর কাছে বিনয়ী থাকার, সৎকর্মশীল থাকার নির্ভিক সত্যনিষ্ঠ থাকার প্রার্থনা করতেন। একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করতেন।

 

অহংকার আমাদের দুনিয়া, আখেরাত বরবাদ করে দেয়। আমাদের অহংকার বা বিনয় প্রকাশিত হয় আমাদের কর্মে।

 

হিটলার, মুসোলিনী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধংশস্তুপ থেকে জার্মানি, ইতালিকে অজেয় পরাশক্তি বানিয়েছে। কিন্তু তাদের অন্ধ অহমিকা আর প্রতিশোধের নেশা তাদের ইতিহাসের আবর্জনায় পরিণত করেছে।

 

হিটলার, মুসোলিনীর উত্থান-পতনের বিপরীতে বিশ্বজয়ের অব্যর্থ রণনীতির যে উপমা ইসলামের নবী রেখে গেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।

 

নবীজীর পথে কাঁটা দেয়া বুড়ির সেবা করার গল্প আমরা শুনি বিভিন্ন ওয়াজে। তবে এ কাজ করার জন্য নবীজীর মতো মহামানব হওয়ার দরকার নাই। একজন সাধারণ ভালো মানুষও এমনটাই করবে। একটা বুড়ি, তাও আবার অসুস্থ। তার খোঁজ খবর নেয়া তো একেবারে সাধারণ ভদ্রতা। মরণাপন্ন বুড়ির উপর প্রতিশোধ নেয়া একজন সাধারণ ভদ্রলোকের জন্যও বেমানান।

কিন্তু প্রবল প্রতাপশালী শত্রুকে শুধু ক্ষমা নয়, প্রধান মিত্রে পরিণত করেছেন, তার অসংখ্য নজির ইসলামের নবী রেখে গেছেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

 

বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিপক্ষদলের সেনাপতি আবু জেহেল মারা যাওয়ার পর ওহুদ, খন্দক সহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল যুদ্ধে সেনাপতি ছিলেন আবু সুফিয়ান। ওহুদের যুদ্ধে নবীজী(সাঃ)-এর চাচা মহাবীর আমীর হামজার মৃতদেহের বুক চিরে কলিজা বের করে খেয়েছে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা। কিন্তু নবীজী(সাঃ) মক্কা বিজয়ের পর ঘোষণা দিলেন, যারা আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে তারা নিরাপদ। তৎকালিন আরবে এটা ছিলো সর্বোচ্চ সম্মান দেখানোর রীতি।

শুধু আবু সুফিয়ান নয়, আবু সুফিয়ান যাদের আশ্রয় দেবে তারাও নিরাপদ।

 

এটা শুধু যুদ্ধকৌশল নয়, রাসুল(সাঃ) তার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায় আবু সুফিয়ানের মতো প্রধান শত্রুকে প্রধান মিত্রে পরিণত করেছেন।

 

আবু সুফিয়ানের ছেলে হযরত মুয়াবিয়া(রাঃ) প্রায় দুই দশক মুসলিম জাহানের খলিফা ছিলেন এবং পরবর্তিতে উমাইয়ারা প্রায় ১০০ বছর মুসলিম বিশ্ব শাসন করে। এই উমাইয়া বংশ মানে আবু সুফিয়ান বংশ।

 

ওহুদের যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদের পালটা আক্রমণে মুসলমানরা বিপর্যস্ত হয়। সে খালিদ বিন ওয়ালিদ শুধু ক্ষমাই পাননি, নবীজী(সাঃ) তাকে “সাইফুল্লাহ” বা আল্লাহর তলোয়ার উপাধিতে সম্মানিত করেছেন। তিনি দুনিয়া বিস্তৃত মুসলিম  জাহানের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হয়েছেন। শতাধিক যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় এনে দিয়েছেন, দিগবিজয়ী মহাবীর খালিদ বিন ওয়ালিদ। 

 

‘সম্প্রতি পাকিস্তানের এক ফুলব্রাইট ফেলো, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার দায়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। তার পক্ষে মামলা লড়ায়, তার আইনজীবীকে গুলি করে হত্যা করে উগ্রবাদীরা।

কিন্তু নবীজী(সাঃ)-এর প্রধান প্রতিপক্ষ আবু জাহেল পুত্র ইকরিমা বদর, ওহুদ যুদ্ধে তো অনেক সাহাবীকে হত্যা করেছেই, মক্কা বিজয়ের সময়েও হারামের সীমানায় অর্থাৎ যুদ্ধ নিষিদ্ধ এলাকায় মুসলমানদের উপর ইকরিমা ব্যর্থ আক্রমণ করে।

আবু সুফিয়ান সহ মক্কার সকল কাফেররা সাধারণ ক্ষমা পেলেও, ইকরিমার মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়া হয় যুদ্ধাপরাধের দায়ে। ইকরিমা মক্কা থেকে পালিয়ে যায়। তার স্ত্রী এসে তার হয়ে নবীজীর কাছে ক্ষমা চাইলে নবীজী ইকরিমাকে মক্কায় ফিরে আসতে বলেন। ইকরিমাকে ফিরে আসতে দেখে নবীজী সবাইকে বললেন, ইকরিমা ইবনে আবু জাহেল আসছে। তোমরা তার সামনে তার বাবাকে গালি দিও না।

হযরত ইকরিমা(রাঃ) নবীজী(সাঃ)-এর এই অবিশ্বাস্য ক্ষমায় অভিভুত হয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি ওয়াদা করছি, ইসলামের বিরুদ্ধে যতো শক্তি আর অর্থ আমি ব্যয় করেছি, ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আমি তার দ্বিগূণ করবো”।

 

রোমান সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ‘ইয়ারমুকের’ মহাযুদ্ধে  সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ যখন পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিলেন, হযরত ইকরিমা বললেন, আল্লাহর রাসুলের সাথে আমার কিছু ওয়াদা আছে। সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের হুঁশিয়ারী অগ্রাহ্য করে হযরত ইকরিমা দুর্ধর্শ রোমান সৈন্যদের দুর্ভেদ্য চক্র ভেদ করেন। অতিমানবের মতো লড়াই করে প্রতাপশালী রোমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিতিয়েছেন হযরত ইকরিমা ইবনে আবু জেহেল।

খালিদ বিন ওয়ালিদের পরিবর্তে ইকরিমা ইবনে আবু জেহেল মুসলিম জাহানের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন।

 

ইকরিমার মতো বিষবৃক্ষকে যিনি দেবদূতে পরিণত করতে পারেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তার চেয়ে শক্তিমান নেতা আর কে?

 

ভিন্নমত সত্বেও তাদের মঙ্গল কামনা করতে পারাই সৎকর্ম। ইকরিমার মতো জঘণ্য যুদ্ধাপরাধীকে নিঃশর্ত ক্ষমা ও সেনাপতির মর্যাদা দিতে পারাই নবীর হিকমা।

 

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়;-

 

“যাহারা তোমার বিষায়েছে বায়ু নিভায়েছে তব আলো,

তুমি তাদের ক্ষমা করিয়াছো, তুমি কি বেসেছো ভালো”?

 

পৃথিবীর ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়া প্রজ্ঞাবান মানুষদের তালিকায় হযরত মোহাম্মদ(সাঃ) প্রথম। কারণ, “তিনি ঊঁটের দুধ পান করতেন, খেজুর খেতেন, তিনি বগলের নিচের পশম টেনে টেনে তুলতেন, তিনি জয়তুনের ডাল দিয়ে মেছওয়াক করতেন, ডান হাতে পানি পান করতেন”- আলহামদুলিল্লাহ! আমরা আহাম্মকউল্লারা বয়ান করছি হিকমাউল্লাহর জীবনাদর্শ!

 

হাদীসের কিতাবে নবীজীর প্রজ্ঞার বিবরণ আছে, তবে তা আমাদের নজরে পড়ে না। কারণ আমরা খুঁজছি ঊঁটের মুতের ফজিলত আর ঢিলা কলুপের ফাজায়েল। হাদীসের সাত সমুদ্র সেঁচে আমরা কোরআনের সাথে সম্পর্কহীন দুনিয়া, আখেরাতের গুরুত্বহীন কিছু বিতর্কিত বিষয় তুলে আনি।

 

‘টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরলে সে জাহান্নামে যাবে’, এটা কোনো প্রজ্ঞাবান মানুষের কথা হতে পারে? নবীজী(সাঃ) এমন কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, যারা অহংকারবশতঃ টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরে, তারা আল্লাহর কৃপাদৃষ্টি পাবে না। এ হাদীসের “কী ওয়ার্ড” হচ্ছে “অহংকারবশতঃ’।

 



হাদীসের পরের অংশে লেখা আছে, হযরত আবু বক্কর(রাঃ) বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমার নিজেরইতো টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলে থাকে”? নবীজী(সাঃ) বললেন, ‘আপনি তো এটা অহংকারবশতঃ করেন না’।

 

অহংকার করে কেউ যদি একটা টুপিও মাথায় দেয়, সেও গোনাহগার। অহংকারবোধ থেকে কেউ যদি নামের আগে আল্লামা, নামের শেষে মাদানী, আযহারী লাগায়, সেও আল্লাহর কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্ছিত হবে। অহংকার অমার্জনীয় অপরাধ। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না। কিন্তু টাখনুর নিচে কাপড় নামা আর হাঁটুর উপর কাপড় ওঠা নিয়েই আমাদের রাজ্যের গবেষণা। কারণ, আল্লাহ নবীকে দিয়েছেন হিকমা আর আমাদের দিয়েছেন আহাম্মকি।

 

হযরত ইবারহীম(আঃ)-এর সময়ে বেশিরভাগ মানুষ চুরি-ডাকাতি করে উপার্জন করতো। বানিজ্য কাফেলা বা মুসাফিরের সর্বস্ব কেড়ে নিতো। দাস হিসাবে বিক্রী করে দিতো।

হযরত ইব্রাহীম(আঃ) বললেন, ‘তোমরা যে লুটপাট করো, তোমাদের এ উপার্জন তো হালাল নয়। তোমরা এ হারাম কামাইয়ে কেনা কাপড় পড়ে আল্লাহর ঘরে আসবে না’।

পরবর্তিতে আবু জেহেলরা ইব্রাহীম(আঃ)-এর এই হাদীসের ভিত্তিতে ল্যাংটা হয়ে ক্কাবা তাওয়াফ করা শুরু করে। কারণ, তাদের কামাই হারাম। আর ইব্রাহীম(আঃ) বলেছে, হারাম কামাইয়ের কাপড় পরে আল্লাহর ঘরে আসবে না। তাহলে উপায় কি? ল্যাংটা!

 

হযরত ইব্রাহীম(আঃ) বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তোমরা হালাল উপার্জন করো। কিন্তু তিনি তো আর বুঝতে পারেননি যে, এই আহাম্মকের দল ল্যাংটা হয়ে ক্কাবা তাওয়াফ করবে, তবু চুরি-ডাকাতি ছাড়বে না।

 

(সজল রোশণের ভিডিও অবলম্বনে

 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url