বিদায় হজ্বের ভাষণ নিয়ে মিথ্যাচার

‘হাদীসের নামে মুসলমানদের ভুল রাস্তা দেখিয়ে দেয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ নিয়ে মিথ্যাচার। হাদীসের সবচেয়ে বড় ঘবিদায় হজ্বের ভাষণ নিয়ে মিথ্যাচার

 

‘হাদীসের নামে মুসলমানদের ভুল রাস্তা দেখিয়ে দেয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ নিয়ে মিথ্যাচার। হাদীসের সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে বিদায় হজ্জ্ব। লক্ষাধিক সাহাবীর উপস্থিতিতে নবীজী (সাঃ) যে ভাষণ দিয়েছেন তা নিয়ে তো মিথ্যচার সম্ভব না, তাই না’?

 

এই লেখায় নবীজী (সাঃ)-এর বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত কিন্তু অসত্য বা উদ্দেশ্যমূলক প্রচারনা নিয়ে কথা বলবো। শিয়া, সুন্নী সহ অসংখ্য দল, উপদলের বিভক্তি, হাদীসকে কোরআনের শরীক হিসাবে শারীয়ার উৎস বানানোর ভিত্তি বিদায় হজ্জ্ব ও গাদিরেখুমের ভাষণ।

বলাবাহুল্য, এ দুটি ভাষণের ‘টেক্সট’ কোরআনে উল্লেখ না থাকায় আমরা হাদীস গবেষণা পদ্ধতি অনুযায়ী এ দুটি ভাষণের সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করবো।

 

ধর্মের নামে আমরা যা জানি, মানি বা মানুষকে মানতে বাধ্য করি তার সাথে যখনই কোরআনের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না, তখনই এক কথায় উত্তর মেলে, ‘শরীয়তের বিধান হচ্ছে কোরান এবং হাদীস”। তো হাদীসের কোন পর্যন্ত শরীয়তের বিধান? সবার আগে অবশ্যই সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিম। এ দুটি হাদীস গ্রন্থ সহীহ হাদীসের সংকলন বিধায় এগুলির নামের আগে ‘সহীহ’ লেখা হয়।

 

তিরমিজী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজা এই ৪ টি গ্রন্থে অনেক হাসান, যঈফ হাদীসও আছে। কিন্তু এই ৪টি হাদীস গ্রন্থকেও ছিয়াছিত্তা বা ৬টি বিশুদ্ধ হাদীসের তালিকায় গন্য করা হয়। এই ৬টি হাদীস গ্রন্থকে ছিয়াছিত্তা বা বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বলা হলেও এগুলো মূলতঃ প্রসিদ্ধ ৬টি কিতাব। বিশুদ্ধ কথাটা “বাজারি কথাবার্তা”।

 

এর বাইরেও শতাধিক মৌলিক ও সম্পাদিত হাদীস গ্রন্থ আছে। ‘এগুলো হাদীসে আছে’ বলে যা আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখিনি বা প্রয়োজন মনে করিনি যে, আসলে কি হাদীসে আছে?

 

কোরআনের একটা আয়াত জানে না এমন অনেক মুসলমানও জানে যে, নবীজী (সাঃ) বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে কোরআন ও সুন্নাহ আকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। বিদায় হজ্জ্বের ভাষণের বিভিন্ন পোষ্টার বা প্লাকার্ড অনেকের বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে চোখে পড়ে। তাতেও এমন কথাই লেখা আছে এবং সেই অনুযায়ী আমরা হাদীসকে কোরআনের মতো শারীয়ার ভিত্তি হিসেবে মানি।

 

এই লেখায় বিদায় হজ্বের ভাষণ সংক্রান্ত হাদীসগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখাবো যে, নবীজী এই ভাষণে কেবলমাত্র কোরান আকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। এই লেখা থেকে আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন। এরপরও আপনি কোনো শায়খুল হাদীসকে দিয়ে যাচাই করিয়ে নিতে পারেন।

 

ইসলাম ধর্মের মূল সংবিধান হচ্ছে কোরআন। নবীজী (সাঃ) এবং তার প্রধান সহচররা কোরআনের নিরবচ্ছিন্ন অনুসারী ছিলেন। কিন্তু ইসলামের নামে আমরা যা ধর্ম চর্চা করছি তার সাথে কোরআনের খুব একটা সম্পর্ক নাই। যারা বিভিন্ন পোষাকী রীতি রেওয়াজকে ধর্ম হিসাবে জেনে বা মেনে আসছেন তারা কোরআন কেন্দ্রিক ধর্মচর্চাকে ইসলাম বলে মানতে নারাজ। শুধু কোরআন অনুসরণ করলে নাকি ইসলামের আর কিছুই থাকে না! সুতরাং এটা মুসলমানদের ইমান নষ্ট করার জন্য ইহুদী নাসারাদের একটি চক্রান্ত!

কাবার ইমাম থেকে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পর্যন্ত পৃথিবীর সকল আলেম স্কলারকে এমন দালাল উপাধি পেতে হয়েছে।

 

সহীহ হাদীস অস্বীকার করলে যদি কুফরী হয়, তবে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনকারী ইমাম ও শায়খুল হাদীসরাও ওই তালিকায় পড়বেন। কারণ সবাই কিছু কিছু হাদীস অস্বীকার করেছেন ও করছেন।

 

হাদীস ও ফেকাহ অনুসরণের কারণ, অকারণ নিয়েও এই লেখায় কিছু কথা বলবো, যা হয়তো আপনি প্রথমবার শুনবেন।

 

যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা, অপপ্রয়োগে বিরক্ত, ধর্মকে মানবিক মূল্যবোধ ও প্রগতির প্রতিবন্ধকতা ভেবেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতায় সমাধান খুজছেন, তারা কোরআনের সরল সৌন্দর্য, চিরন্তন নীতিমালা এবং যৌক্তিক নির্দেশনায় অভিভূত হয়েছেন। এমনকি বিধর্মীরাও মনে করেন, কোরআনের বিধিনিষেধে কোনো রকম সংমিশ্রণ ছাড়া যারা তুলে ধরছেন, তাতে ইসলামের সমালোচনা করার সুযোগ নাই। কিন্তু বিভিন্ন হাদীস তাফসির ও ফেকাহ মিশিয়ে ধর্মের যে পরিচিত রূপ আমরা দেখছি, তার সাথে আমাদের দ্বিমত করতেই হচ্ছে।

 

কোরআন চিরন্তণ, কিন্তু হাদীস, তাফসির এবং ফেকাহ চিরন্তণ নয়। হাদীস, তাফসির, ফেকাহ সবকিছুরই কিছু প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিক ভিত্তি আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রাধাণ্যতা বা অগ্রগণ্যতা না বোঝা। “আমি হাদীস, তাফসির ইসলামের ইতিহাস, সাহিত্য - সব পড়ি এবং পড়তে উৎসাহ দেই”। কিন্তু ইসলামের চিরন্তণ বিধান একমাত্র কোরআন।

 

নবীজী (সাঃ) এবং প্রধান সাহাবীদের জীবনাচরণের কোনো প্রতিষ্ঠিত নথি যদি পাওয়া যায়, তা অনুসরণ অবশ্যই উত্তম,- যদি তা কোরআনের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। কোরআনের সাথে সম্পর্কহীন এবং সামঞ্জস্যহীন হাদীস শরীয়তের বিধান হিসেবে অকার্যকর। কারণ নবীজী (সাঃ) এবং তার সাহাবীগণ কোরআন পরিপন্থী কোনো কাজ করেছেন বা বলেছেন, এমনটা একজন মুসলমান নীতিগতভাবে বিশ্বাস করতে পারে না।

 

একটা দেশের কোনো আইন যেমন সে দেশের সংবিধান পরিপন্থী হতে পারে না। তেমনি ইসলামের কোনো আইনও কোরআন পরিপন্থি হতে পারে না।

 

হাদীসের নামে মুসলমানদের ভুল রাস্তা দেখিয়ে দেয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ নিয়ে মিথ্যাচার। হাদীসের সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে বিদায় হজ্জ্ব। লক্ষাধিক সাহাবীর উপস্থিতিতে নবীজী (সাঃ) যে ভাষণ দিয়েছেন তা নিয়ে তো মিথ্যচার সম্ভব না, তাই না?

 

আমরা সবাই জানি, নবীজী (সাঃ) বলেছেন, “আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। এ দুটি জিনিস আকড়ে ধরলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং আরেকটি হচ্ছে আমার সুন্নাহ বা হাদীস”।- ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা এ হাদীস ‘জাতীয় সংগীতের’ চেয়েও বেশিবার শুনেছেন। বিদায় হজ্জ্বের ভাষণের এমন অনেক বাহারী পোষ্টার বা প্লাকার্ড বাজারে বিক্রী হয়। তা কারা ছাপায়, কারা বিক্রী করে আমরা জানি না।

 

“দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও আরেকটি আমার সুন্নাহ” - হাদীসের এই ‘জাতীয়সংগীত’ ছিয়াছিত্তা অর্থাৎ হাদীসের ৬ প্রসিদ্ধ কিতাব - বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজা; কোনো কিতাবে নাই। এমনকি মুসনাদ আহমাদ, বাইহাকী, সহীহ ইবনে হিব্বান, দারেমী শরীফের মতো হাদীস গ্রন্থেও নাই।

এই বিখ্যাত হাদীসগ্রন্থগুলি বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজীরা, প্রথম আলোর মতো প্রসিদ্ধ বা নির্ভরযোগ্য! এদের সব সংবাদ সত্য না হলেও এরা কোনো সংবাদ প্রচার করলে মানুষ সেটাকে গুরুত্বের সাথেই নেয়।

 

এর বাইরে আরো অন্তত শতাধিক হাদীস গ্রন্থ আছে, যেগুলো বিভিন্ন দল, মতের মুখপত্র বিধায় এগুলো সার্বজনীন গ্রহনযোগ্যতা পায়নি। অনেকটা দৈনিক সংগ্রাম, ইনকিলাব, আমার দেশ, দিনকাল, যায়যায় দিন বা একেবারে ভুইফোর পত্রিকা যেমন; দৈনিক যুগের বাণী, যুগের চিন্তা, আশার আলো ইত্যাদির মতো। এসবের খবর কেউ গুরুত্ব দেয় না। আর এমন অখ্যাত বা দলীয় প্রচারপত্রে প্রকাশিত সংবাদ যদি মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে না থাকে, তা গুজব বলেই ধরা হয়।

এমনই হাদীস গ্রন্থ “মুস্তাদরাক আল হাকীম” নামক তুলনামূলক অখ্যাত হাদীস গ্রন্থে, অখ্যাত সূত্রে এ হাদীস থাকলেও তাতে বিদায় হজ্জ্বের ভাষণের আর কোনো বিষয়ে আলোচনা নাই। এতো গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের মাত্র এই দুই লাইনই বর্ণনাকারীর মনে আছে, এটা কিভাবে সম্ভব!

 

মালেকী মাযহাবের মুখপাত্র “মুয়াত্তা মালেকে” এ দুই লাইনের হাদীস মুরসাল সূত্রে বর্ণিত আছে। মুরসাল শব্দের অর্থ পরিত্যাজ্য। মুরসাল হাদীস হচ্ছে, যে বর্ণনাকারী হাদীস বর্ণনা করেছে, বিদায় হজ্জ্বের সময় তার জন্মই হয়নি। তাহলে সে নিশ্চই কারো কাছ থেকে শুনেছে। কিন্তু কার কাছ থেকে শুনেছে তার নাম পরিচয় সে বলতে পারেনি।

 

মেসকাত শরীফে মুস্তাদরাক আল হাকীমে উল্লেখিত হাদীসটিই উল্লেখ আছে। মেসকাত শরীফ, রিয়াদুস সালেহীন মূলত বিভিন্ন হদীস গ্রন্থ থেকে বিষয়ভিত্তিক বাছাইকৃত হাদীসের সংগ্রহ। এই হাদীস গ্রন্থগুলো বিভিন্ন টেলিভিশনের “আজকের পত্রিকা” অনুষ্ঠানের মতো। যেখানে প্রধান প্রধান সংবাদপত্রের প্রধান প্রধান খবরগুলো পড়ে শোনানো হয়। পত্রিকাগুলো যা লিখেছে তাই পড়ে শোনাবে।

একইভাবে মেশকাত শরীফ টাইপের হাদীস গ্রন্থগুলোতে বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থের কিছু হাদীস হুবহু ছাপায়। এরকম হাদীস গ্রন্থ আছে কয়েক হাজার।

 

এখন এর বিপরীতে আসল কথা শুনুনঃ

এই বিদায় হজ্জ্বের হাদীস প্রসংগে সর্বমোট দুটি হাদীস আছে ছিয়াছিত্তা সহ বিখ্যাত হাদীসের কিতাবে। একটি সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন হজ্জ্ব অধ্যায় হাদীস নম্বর ২৮২১।

দ্বিতীয়টি সুনানে আবু দাউদ, হজ্জ্ব অধ্যায়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন হাদীস নম্বর ১৯০৩।

 

দুটি হাদীসই অনেক লম্বা, কয়েক পৃষ্ঠা। নবীজী (সাঃ)-এর বিদায় হজ্জ্বের সম্পূর্ণ সফরের বিস্তারিত বর্ণনা আছে তাতে। তবে সংশ্লিষ্ট অংশটুকু তুলে ধরছিঃ


সহীহ মুসলিমের বর্ণনাঃ

“আমি তোমাদের মাঝে এমন এক জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা দৃড়ভাবে আকড়ে ধরে থাকলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না, তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব”।


সুনানে আবু দাউদের বর্ণনাঃ

“আমি তোমাদের মধ্যে একটি বিশেষ বস্তু রেখে যাচ্ছি, আমার পর তা যদি তোমরা মজবুতভাবে ধারণ করো, তবে তোমরা কখনো গোমরাহ হবে না; আর তা হলো, আল্লাহর কিতাব”।

 

দুটি বর্ণনামতেই এরপর নবীজী (সাঃ) সমবেত সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন আমার সম্পর্কে জিজ্ঞ্যেস করা হবে, তখন তোমরা আমার সম্পর্কে কি বলবে”?

সাহাবীগণ বললেন, “ আমরা সাক্ষ্য দেবো যে, আপনি আপনার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন, আপনার হক আদায় করেছেন, উম্মতকে নসিহত করেছেন”।

অতঃপর তিনি শাহাদত আঙ্গুলি আকাশের দিকে উত্তোলন করলেন এবং লোকদের প্রতি ইশারা করলেন; “হে আল্লাহ তুমি স্বাক্ষী থাকো”, “হে আল্লাহ তুমি স্বাক্ষী থাকো”, “হে আল্লাহ তুমি স্বাক্ষী থাকো”।

 

অর্থাৎ হাদীস মোতাবেক বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে নবীজী একটি জিনিস আকড়ে ধরতে বলেছেন, আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব।

কিন্তু একটির জায়গায় দুটি জিনিস ‘কোরানের সাথে হাদীস যোগ করেছে কিছু অখ্যাত, অসমর্থিত সূত্র’। মূলধারার হাদীস গ্রন্থ অনুযায়ী নবীজী (সাঃ) মাত্র একটি জিনিস আকড়ে ধরতে বলেছেন, আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। একথাটাই সকলের কাছে পৌছে দিতে নবীজী (সাঃ) উপস্থিত সাহাবীদের আদেশ করেছেন। কিন্তু একথাটি আমাদের কাছে পৌছেনি। কেনো পৌছেনি?

 

ইতিহাস, ভূগোলের আলোচনায় গেলাম না। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে অনুদিত ও প্রকাশিত সহীহ মুসলিম আর আবু দাউদে এ হাদীস স্পষ্টাক্ষরে ছাপানো। তা আমাদের শায়খুল হাদীসদের চোখে পড়েনি?

পড়েছে নিশ্চয়ই। কারণ এ হাদীস অনুযায়ী আমরা হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করি। এতে নবীজী (সাঃ)-এর হজ্জ্বের সফরের বিস্তারিত বিবরণ আছে। কিন্তু তারা এ হাদীস আমাদের কাছে বলেনি। কেনো? বললে চাকরি থাকবে না?

উলটো তারা আমাদের কোরআন ও সুন্নাহ অনুসরণের যে বর্ণনা শুনাচ্ছেন তা ছিয়াছিত্তার কোনো কিতাবে নেই।

 

আমাদের কথা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে না। আপনি কোনো শায়খুল হাদীসকে প্রশ্ন করেন। যে, “নবীজী (সাঃ) বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে কোরআন ও তার সুন্নাহ আকড়ে ধরার যে নির্দেশ আমাদেরকে দিয়েছেন, তা ছিয়াছিত্তার কোন কিতাবে আছে? আর ছিয়াছিত্তায় বিদায় হজ্জ্বের ভাষণের যে নির্দেশ আছে তাতে কি আকড়ে ধরতে বলা হয়েছে”?

 

‘আমি ফেসবুকে ফ্যাক্ট চেক করার জন্য পোষ্ট দিয়েছিলাম। তাতে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বিখ্যাত আলেমও বেশ বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন যে, বলেন কি? অনেক খোজাখুজি করে যখন পছন্দসই হাদীস পাওয়া গেলো যায়নি, অনেকেই আস্তে চেপে গেলেন ব্যাপারটা। তাহলে আমরা হাদীস মানছি কই’?

 

মুসলিম ও তিরমিজী শরীফে ‘দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি’ এমন বর্ণনা আছে, তবে তা বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ না, গাদিরেখুমের ভাষণে।

নবীজী (সাঃ) বিদায় হজ্জ্ব থেকে ফেরার পথে মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি গাদিরেখুম নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করেন এবং সেখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যা শিয়া ও পাক পাঞ্জাতন পন্থীরা “ইদুল গাদির” নামে প্রতি বছর উদযাপন করে। যদিও আমরা সুন্নীরা গাদিরেখুম সম্পর্কে খুব একটা জানিনা।

 

গাদিরেখুমে যে দুটি জিনিস আকড়ে ধরতে বলেছেন বলে মুসলিম, তিরমিজী শরীফে বর্ণিত আছে তার একটি কোরআন, আরেকটি ‘আহলে বায়েত’- নবী পরিবার। তিরমিজী শরীফের আরেকটি হাদীসে ‘আহলে বায়েত’ বলতে কেবল হযরত আলী, ফাতেমা, হাসান, হোসাইন (রা)- এই ৪ জনকে বলা হয়েছে, যা শিয়া আর তরিকত পন্থী একাংশের ‘জাতীয় সংগীত’।

কিন্তু নবী পরিবার হিসাবে কেবল এই ৪ জনকে নির্বাচন করা কোরআনের বক্তব্যের বিপরীত। সুরা আহযাবে ‘আহলে বায়েত’ বলতে প্রধাণতঃ নবীজীর স্ত্রীদের উদ্দেশ্য করা হয়েছে। তাদেরকে ‘উম্মুল মু্মীনীন বা মুমীনদের ‘মা’ বলা হয়েছে। এমনকি, পবিত্রতা ও মর্যাদা বিবেচনায় নবী পত্নীদের সাথে পরবর্তীতে মুমীনদের বিবাহকে হারাম করা হয়েছে।

এছাড়া নবীজীর জামাতা হযরত ওসমান, শ্বশুর হিসাবে হযরত ওমর, আবু বক্কর (রাঃ)- এরাও নবী পরিবারভুক্ত।

 

এই গাদিরেখুমের হাদীসগুলো নিয়েই মুলত শিয়া – সুন্নী বিভক্তি। শিয়া, পাক পাঞ্জাতন বিশ্বাস অনুযায়ী নবীজী (সাঃ) এই গাদিরেখুমে হযরত আলী (রাঃ) কে পরবর্তী মুসলিম বিশ্বের মওলা, ওলি, অভিভাবক বা খলিফা হিসাবে ঘোষণা করেন।  এই ইমাম বা ওলি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত বিশেষ দূত।

এই গাদিরেখুমের ভাষণ বা হাদীস অনুযায়ী শিয়ারা কলেমার সাথে “আলী ওলিউল্লাহ” পড়ে। আযান ইকামতে “আসহাদুয়ান্নাহ আলী ওলিউল্লাহ” বলে।

গাদিরেখুমের হাদীস অনুযায়ী শিয়ারা বিশ্বাস করে কিয়ামত পর্যন্ত মোট ১২ জন ইমাম আল্লাহর পক্ষ থেকে ইমামত নিয়ে আসবেন, যারা মুসলিম বিশ্বকে রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব দেবেন। যার প্রথম জন হযরত আলী (রাঃ) এবং শেষজন ইমাম মাহদী।

এই ১২ ইমামের কোনো ইংগিত কোরআনে না থাকলেও শিয়ারা এই ১২ জন ইমামকে নবীদের মতো বিশেষ দূত মনে করে। এদের নামের সাথে “আলাইহিস সাল্লাম” ব্যবহার করে এবং এটাকে ইমানের অপরিহার্য অংশ মনে করে।

১২ ইমামে বিশ্বাস করে বিধায় মূলধারার শিয়াদের “Twelver Shi’ah” বলা হয়।

ইসমাইলী শিয়ারা ইসমাইল বিন জাফরকে এই ১২ ইমামের একজন মনে করে, যা Twelver রা মনে করে না।

 

মূলধারার সুন্নীরা ইমাম তত্বে বিশ্বাস না করলেও বিচ্ছিন্নভাবে ইমাম মাহদীর ধারণায় বিশ্বাস করে। এই ইমাম মাহদী এবং দজ্জালের কথা কোরআনে ঘুনাক্ষরেও না থাকলেও আমরা ইমাম মাহদী আবির্ভাবের ক্ষণ গণনা শুরু করে দিয়েছি। এ পর্যন্ত অসংখ্যা মানুষ নিজেকে ইমাম মাহদী দাবী করেছে এবং ভিন্নমতের মানুষদের দজ্জাল উপাধী দেয়া হয়েছে।

 

আমাদের দেশের শিয়ারা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখেই ইসলাম প্রচার করে। আমরা আমাদের অজান্তেই অনেক শিয়া বিশ্বাস গ্রহণ করেছি। আমাদের শাসক নবাবদের অনেকেই ছিলো শিয়া। আমাদের দেশে অনেক মানুষের নামের সাথেই আলী, হাসান, হোসাইন আছে, যেগুলো মূলত শিয়া নাম।

 

এখন ইমাম মেহেদীর হাদীস মানলে গাদিরেখুমের অন্যান্য হাদীস যেমন; আহলে বাইত, পাক পাঞ্জাতন, মওলা আলী বা ১২ ইমামের হাদীসও মানতে হবে। কারণ এগুলো সব একই মানের হাদীস। এছাড়া গাদিরেখুম বিশ্বাস করলে নবীজীর স্ত্রীগন সহ হযরত আবু বক্কর, উমর, ওসমান (রাঃ) এবং তাদের অনুগত সকল সাহাবীকে মুরতাদ হিসেবে বিশ্বাস করতে হবে।

 

তাদের বর্ণিত কোনো হাদীস গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এ কারণেই শিয়া ও সুন্নীদের হাদীস আলাদা। সুন্নীদের হাদীস তথা; ছিয়াছিত্তায় ‘হযরত আবু হুরাইরা’, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে উমর’, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস’, ‘আবু সাঈদ খুদরী’, উম্মুল মুমীনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসের প্রাধান্য থাকলেও শিয়ারা এসব হাদীস জানেও না, মানা তো পরের কথা।

 

এখন “মুয়াত্তা মালেক” ও “মুস্তাদরাক হাকীম” গ্রন্থে কোরআন ও হাদীস আকড়ে ধরার বিপরীতে “মুসলিম” ও “তিরমিজী”তে কোরআন ও আহলে বাইত এসেছে। অর্থাৎ এ হাদীসগুলো পরস্পর বিরোধী। এ হাদীসগুলো কোরআনের বক্তব্যেরও বিরোধী।

 

কোরআন কোরআনকে সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, বিশদ, বিস্তারিত ও একমাত্র ধর্মীয় বিধান হিসাবে অনুমোদন দেয়। কোরআন কোরআনকেই “হুদাল্লিল মুত্তাকিন” বলেছে।

নবীজী (সাঃ) এর কথা, কাজের বিশদ বিবরণও কোরআনেই আছে। কোরআন “আহলে বাইত” বলতে নবীপত্নীদেরকে উদ্দেশ্য করেছে। এর বাইরে কোরআন আমাদেরকে যা নির্দিষ্ট করে বলেনি তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার কি? আমরা আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর নিচ্ছি কেনো? উম্মুল মুমীনীন বা খোলাফায়ে রাশেদীনের বিচার করার দায়িত্ব আমাদেরকে কে দিলো?

 

হাদীস শাস্ত্রের স্বীকৃত মূলনীতি অনুযায়ী কোনো হাদীস কোরআনের বক্তব্যের বিরোধী হলে তা বাতিল। কোনো একটি হাদীস আরেকটি হাদীসের বিরোধী হলে দুইটাই বাতিল। কোনো হাদীস স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক ধারণা বা প্রমানিত জ্ঞানের পরিপন্থী হলে তা অকার্যকর। তাই হাদীস শাস্ত্রের সর্বসম্মত মূলনীতি অনুযায়ী “দুটি জিনিস রেখে যাওয়া, ‘সুন্নাহ ও আহলে বাইতে”র হাদীসগুলো অকার্যকর।

 

সুতরাং বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ অনুযায়ী নবীজী (সাঃ) এর অন্তীম উপদেশ হচ্ছে কোরআনের নিরবচ্ছিন্ন অনুসরণ। হাদীসকে কোরআনের সমকক্ষ মনে করলে এ হাদীস অনুযায়ীই কি আমরা মুনকারিনে হাদীস বা হাদীস অস্বীকারকারী নয়?

 

বিদায় হজ্জ্বের ভাষণের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুকে মানুষের কাছ থেকে আড়াল করে রাখা অন্যায়, অবিচার, অসততা। জেনেশুনে সত্য গোপন করে মিথ্যা ভূঁইফোর হাদীস প্রচার করা জালিয়াতি। সত্য প্রচারের উদ্দেশ্য থাকলে অন্তত ৪টি হাদীসই সনদের মান অনুযায়ী বর্ণনা করতে হবে।

 

এক গাদিরেখুম নিয়ে মুসলিম বিশ্বের যে শিয়া, সুন্নী বিভক্তি তা ইসলামের প্রথম শতাব্দী থেকে শুরু করে ইরানের সাফাদি সাম্রাজ্য ও ওসমানী খেলাফতের মধ্যে একাধিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সহ অসংখ্য প্রাণঘাতি সংঘাতের কারণ,- যাতে প্রাণ দিয়েছে কয়েক লক্ষ মুসলমান।

 

কোরআনে এমন কোনো আলোচনা না থাকলেও গাদিরেখুমের পক্ষ-বিপক্ষ, শিয়া, সুন্নীরা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য পরস্পর পরস্পরকে কাফের ফতোয়া দিয়ে সহিংস পথ অনুসরণ করছে। কোরআনের স্পষ্টতর নির্দেশকে পদদলিত করছে।

 

কোরআনের বৃত্তের বাইরে প্রথম কদমেই মুসলিম বিশ্বে শিয়া, সুন্নী দুইভাগে বিভক্ত হয়। এই বিভক্তি বাড়তে বাড়তে মুসলমানরা অসংখ্য দল-উপদলে ভাগ হয়ে পড়ে। আমরা যে যে-দলের মধ্যমে ধর্মে আগ্রহী হই তাদের বর্ণিত ধর্মকেই খাটি ইসলাম বলে মনে করি।


কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু কথিত হাদীসের ভিত্তিতে যে হাজারও মত-পথ, সে হাদীসের সংগ্রহ ও সংকলনের বাস্তবতা জানলে বিদায় হজ্জ্বের ভাষণের মতোই কেঁচো খুঁড়তে অসংখ্য সাপ বেরিয়ে আসতে দেখবেন। "হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণের ইতিবৃত্ত" নামে হাদিস সংগ্রহের তুঘলকি কান্ড-কারখানা নিয়ে আরো একটি লেখা এই সাইটে প্রকাশিত হয়েছে, পড়ে দেখতে পারেন।

মহান আল্লাহ সকলের সঠিক পথে চলার তৌফিক দিন। আমীন।

 

(ইউটিউব থেকে সজল রোশনের ভিডিও অবলম্বনে)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url