হাদীসগ্রন্থ “সহীহ আল বুখারী” রচনাকাল - কিছু প্রশ্ন
হাদীসগ্রন্থ
“সহীহ আল বুখারী” রচনাকাল - কিছু প্রশ্ন
হাদীস গ্রন্থ “সহীহ আল বুখারী”র সংকলক ইমাম বুখারী নবীজীর ইন্তেকালের ১৭৮
বছর পর ১৯ জুলাই ৮১০ খ্রিষ্টাব্দে উজবেকিস্তনের বুখারা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ
করেন। উল্লেখ্য, ওসমানীয় খেলাফত পর্যন্ত উজবেকিস্তান মুসলিম শাসনাধীনে ছিলো। পরে প্রাক্তন
সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্ত্ররভুক্ত হয় এবং ১৯৯১ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেংগে গেলে আলাদা
রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।
ইমাম বুখারীর পুরা নাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাইল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরাহ
বিন বারদিযবাহ। আমিরুল
মুমিনীন ফিল হাদীস তার উপাধি। বুখারা নামক স্থানে জন্ম বিধায় জন্মস্থানের নামানুসারে তার সংক্ষিপ্ত
নাম "ইমাম বুখারী"। তার সংকলিত “সহীহ বুখারী শরীফ” মুসলিমদের কাছে
অন্যতম হাদীস গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। ছিয়াছিত্তার ৬ টি হাদীস গ্রন্থের মধ্যে “সহীহ
আল বুখারী” সর্বোত্তম হাদীস গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
ইমাম বুখারীর বাবার নাম ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিম।
তার দাদার নাম ইব্রাহিম। তার দাদার সম্পর্কে খুব বেশি জানা না গেলেও তার বাবা ইসমাইল
মুসলিম বিশ্বে একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন হাদীসবিদ।
নোটঃ ইমাম বুখারীর দাদা সম্পর্কে বিশেষ কিছু
জানা না গেলেও আমাদের দেশের কিছু পীর সাহেবদের ৫১ তম পূর্বপুরুষ থেকে ধারাবাহিক নামের
তালিকা পাওয়া যায়!
ইমাম বুখারী শৈশবে প্রথমে কোরআন পাঠ শুরু করেন।
মাত্র ৬ বছর বয়সে তিনি কুরআন মুখস্থ করেন। ১০ বছর বয়স থেকে তিনি হাদীস মুখস্থ করা শুরু
করেন। ১৬ বছর বয়সেই তিনি "আবদুল্লাহ বিন মুবারক" এবং "ওয়াকীর পান্ডুলিপিসমূহ"
মুখস্থ করে ফেলেন। মহান আল্লাহ্পাক তাকে অনন্যসাধারণ স্মরণ শক্তি দান করেছিলেন।
তার মা'ও একজন বুজুর্গ মহিলা ছিলেন। তার জীবনীতে উল্লেখ
করা হয়েছে যে, তিনি ছোট থাকতেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহর রহমতে ও তার মায়ের দোয়ায়
পুনরায় দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান।
ইমাম বুখারী ১৬ বছর বয়সে মা এবং বড়ভাইয়ের সাথে হজ্বে
গমন করেন। হজ্বের পর হাদীস সংগ্রহের জন্য মক্কাতে থেকে যান এবং হিজাযের হাদীসবিশারদদের
কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করতে থাকেন। এ সময় তিনি "কাজায়াস সাহাবা ওয়াত তাবীঈন"
নামক গ্রন্থ রচনা করেন।
এক সময় তিনি নিজ দেশে ফিরে আসেন এবং ১৮ বছর বয়সে আবারো
হজ্ব পালনের জন্য মক্কায় গমণ করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীসের চর্চা শুরু
করেন। অতঃপর হাদীস অন্বেষণের জন্য তিনি ইরাক, সিরিয়া ও মিশরসহ বহু
অঞ্চল সফর করেন। একদা ইমাম বুখারি মুহাদ্দিস দাখেলির দরসগাহে যোগ দেন।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর তিনি হাদীস অন্বেষণের ভ্রমণ শেষ করে
নিজ মাতৃভূমি বুখারায় ফিরে আসেন।
১৬ বছর যাবত তিনি এক হাজারেরও অধিক সংখ্যক মুহাদ্দিসের
নিকট থেকে ৬ লক্ষ হাদীস সংগ্রহ এবং মুখস্থ করেন। সেই হিসেবে গড়ে প্রতিদিন তাকে ১০৩
টি করে হাদীস সংগ্রহ বা মুখস্থ করতে হয়েছে!
ইমাম বুখারীর জীবনের শ্রেষ্ঠতম কর্ম হচ্ছে এই হাদীসগ্রন্থের
রচনা। তিনি স্বীয় শিক্ষক ইসহাক বিন রাহওয়াইহ থেকে এই গ্রন্থ রচনার প্রেরণা লাভ করেন।
একদিন ইসহাক এমন একটি গ্রন্থের আশা প্রকাশ করেন, যাতে লিপিবদ্ধ থাকবে শুধু সহীহ হাদীস।
ছাত্রদের মাঝে ইমাম বুখারী তখন এই কঠিন কাজে অগ্রসর হন।
২১৭ হিজরী সালে অর্থাৎ ৮৩৩ খৃষ্টাব্দে মাত্র
২৩ বছর বয়সে তিনি মক্কার হারাম শরীফে এই গ্রন্থের সংকলন শুরু করেন। দীর্ঘ
১৬ বছর পর ২৩৩ হিজরী অর্থাৎ ইংরেজি ৮৫৫ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ নবীজীর ইন্তেকালের ২২৩ বছর
পর এর সংকলনের কাজ সমাপ্ত করেন।
বুখারী শরীফের সংকলনকালে তিনি সর্বদা রোজা রাখতেন
এবং প্রতিটি হাদীস গ্রন্থে সন্নিবেশিত করার আগে গোসল করে দু'রাকাত নফল নামাজ আদায়
করে মুরাকাবা ও ধ্যানের মাধ্যমে হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন।
এই গ্রন্থে তিনি সকল ‘সহীহ হাদীস’ সংকলন করেননি। ‘সহীহ
হাদীসের’ মাঝে যেগুলো তার নির্ধারিত শর্তে উন্নীত হয়েছে, সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি
স্বয়ং বলেন, "আমি জা'মে কিতাবে সহীহ হাদিস ব্যতীত অন্যকোনো হাদীস উল্লেখ করিনি।
তবে কলেবর বড় হয়ে যাওয়ার আশংকায় অনেক সহীহ হাদীস বাদ দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমি আমার কিতাবে প্রতিটি হাদীস লেখার
পূর্বেই গোসল করেছি এবং দু’রাকাআত নামাজ আদায় করে নিয়েছি।
অপর বর্ণনা হতে জানা যায়, ইমাম বুখারী তাঁর
স্বীয় কিতাবের শিরোনামসমূহ রাসুলে করিম এর রওজা এবং মসজিদে নববীর মধ্যস্থলে বসে লিখেছিলেন
এবং প্রত্যেক শিরোনামের জন্য দু’রাকাআত নফল নামাজ আদায় করেছেন।
টিকা:
ইমাম বুখারীর প্রায় ৬ লাখ হাদীস মুখস্থ ছিল। তন্মধ্যে
পূনরোল্লেখ সহ তিনি মোট ৭,৫৬০ টি হাদীস তার গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। বলা হয়েছে, একবার
উল্লেখিত হাদীসের সংখ্যা মাত্র ২২৩০ টি। প্রতিটি হাদীস লিপিবদ্ধ করার আগে তিনি মোরাকাবায়
বসে "ধ্যান" এর মাধ্যমে তার বিশুদ্ধতা নির্ণয় করেন।
অতএব, তাঁর সংগৃহীত ৬ লক্ষ হাদীস থেকে তিনি প্রায় ৫
লক্ষ ৯৩ হাজার হাদীস এবং পুনরোল্লেখ বাদে ৫ লক্ষ ৯৭ হাজার ৭৭০ টি হাদীস বাতিল করে দেন,
যার মধ্যে অনেক সহীহ হাদীসও ছিলো। গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায় তিনি সেগুলোও
বাদ দেন।
প্রশ্ন হলো,
(১) নবীজীর ইন্তেকালের ২০০ বছর পরে কার কাছ
থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে তিনি সহীহ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন?
(২) প্রতিটি হাদীস গ্রন্থে সন্নিবেশিত করার
আগে তিনি মোরকাবা বা ধ্যানের মাধ্যমে হদীসের বিশুদ্ধ্বতা যাচাই করতেন! এই পদ্ধতিতে
শতভাগ বিশুদ্ধতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারটি কি গ্রহণযোগ্য - এর কি কোনো যৌক্তিক
ব্যাখ্যা আছে?
(৩) কিতাবের কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকায় ইমাম
বুখারী ৬ লক্ষ হাদীস থেকে পুনরোল্লেখ বাদে মাত্র ২২৩০ টি হাদীস তার কিতাবে জায়গা দিলেন,
বাকি ৫ লক্ষ ৯৭ হাজার ৭৭০ টি হাদীস যারমধ্যে সহীহ হাদীসও ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন এবং
তা যদি নবীজীর কথা, কাজ, অনুমোদন হয়ে থাকে তাহলে কোন ক্ষমতাবলে তিনি তার কিতাব থেকে
বাদ দিলেন, যা না মানলে সবাই কাফের হয়ে যাবে বলে আলেমগণ ফতোয়া দিয়ে থাকেন?
(৪) নবীজী কি কাউকে এমন দায়িত্ব দিয়েছিলেন?
দিয়ে থাকলে তা হযরত আবু বক্কর, হযরত ওমর, হযরত ওসমান এবং হযরত আলী (রাঃ) অর্থাৎ ইসলামের
প্রথম ৪ খলিফার উপর বর্তানোর কথা। পবিত্র কোরআনের পরে ধর্মের এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
তারা কোরআনের মতো রচনা করে যাননি কেনো?
জানি, এসব প্রশ্নের
মীমাংশা কোনোদিনই হবে না। এই হাদীস ভাঙিয়ে একেকজন একেক রকম ফতোয়া দিয়ে যাচ্ছেন, “এইটা
সহীহ, ওইটা জাল” বলে। এক মৌলানা আরেক মৌলার বিরুদ্ধে ফতোয়া দেন। এ বলে ও কাফের, ও বলে
এ কাফের! এভাবেই যুগযুগ ধরে চলছে। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ দিশেহারা!
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বোঝার এবং সঠিক
জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ধর্মপালনের তৌফিক দিন। আমীন।
কৈফিয়তঃ এই নিবন্ধ রচনায় ইউকিপিডিয়ার সাহায্য
নেয়া হয়েছে।