মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ
আমার বড়মামা, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন খান। আমার মায়ের ছোট। আমার চেয়ে ১১ বছরের বড়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার অবদানের কথা জানানোর জন্য ব্যাক্তিগত আবেগ থেকেই তার সম্পর্কে দু'চার কথা লেখা।
আমার নানাবাড়ি ছিলো পাবনা জেলার সুজানগর থানার সিংহনগর গ্রামে। এখন সে গ্রাম নদীবক্ষে বিলীন। বর্তমান বাড়ি সাতবাড়িয়া বাজার থেকে এক কিলোমিটার পূবে।
মামা বয়সে আমার চেয়ে ১১ বছরের বড় হলেও লেখাপড়া করেছেন একটু বেশি বয়সেই। এটা বোধহয় তখনকার দিনের স্বাভাবিক বিষয় ছিলো।
১৯৬৫ সালের প্রথম দিকের কথা। পঞ্চম শ্রেণীর ফাইনাল এবং বৃত্তি
পরীক্ষা দিয়ে মামা বাড়ি বেড়াতে গেছি। মামা সে বছরই মেট্রিক পরীক্ষার্থী।
মামাবাড়ি গিয়ে মামার নতুন বাইসাইকেল দেখে বায়না ধরলাম সাইকেল চালানো শেখার। কিন্তু অন্যান্য মামাদের জন্য চান্স পাইনা।
বড়মামা এক জায়গায় অংক শিখতে যেতেন। যে কয়দিন ছিলাম, বড়মামা প্রতিদিন আমাকে তার সাথে ডাবলিং করে নিয়ে যেতেন, তার পড়ার সময়টুকু যাতে নির্ঝঞ্ঝাটে সাইকেল চালানো শিখতে পারি সেজন্যে।
মজার ব্যাপার হলো, তিনি যার কাছে অংক শিখতে যেতেন তিনি ছিলেন একজন প্রাইমারি শিক্ষক এবং তিনি নিজেও ছিলেন মেট্রিক পাশ। মেট্রিক পাশ হয়েও মেট্রিক পরীক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন।
শীতের দিন। প্রাইমারি স্কুল প্রাঙ্গনে রোদে পিঠ দিয়ে কয়েকজন মেট্রিক পরীক্ষার্থী সেই শিক্ষকের কাছে অংক শেখায় নিমগ্ন থাকতো। আমি স্কুলের বিরাট খেলার মাঠে সাইকেল দিয়ে চক্কর দিতে থাকতাম। তবে তখন সিট নাগাল পেতাম না। সাইড দিয়ে পা ঢুকিয়ে প্যাডেল ঘুরাতাম।
বড়মামা যখন মেট্রিক পাশ করেন তখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ছাড়া তার নিকটবর্তী কোনো কলেজ ছিলো না। তিনি বাড়ি থেকে প্রতিদিন ১৮x২=৩৬ মাইল অর্থাৎ ৫৮ কিলোমিটার রাস্তা বাইসাইকেল আপ-ডাউন করে পাবনা গিয়ে কলেজ করে বাড়ি ফিরে আসতেন।
১৯৬৯ সালে বিএ ফাইনাল পরীক্ষার তিনমাস আগে টানাপোড়েন সংসারে কিছুটা আর্থিক সহায়তা করার অভিপ্রায়ে কোনোকিছু না বুঝেই পাকিস্তান মিলিটারিতে সুযোগ পেয়ে ভর্তি হয়ে যান। ভর্তির পর তাকে প্রশিক্ষণের জন্য পাকিস্তানের কোয়েটা পাঠানো হয়।
চাকরিটা যে তার জন্য উপযোগী ছিলো না তা বুঝতে পেরে, অতঃপর সামনে বিএ পরীক্ষা-র কথা বলে এক বাঙালি অফিসারের সাহায্যে নাম কাটিয়ে কোয়েটা থেকে দেশে চলে আসেন।
কিন্তু সেই বছর আর তার বিএ পরীক্ষা দেয়া হয়নি। দেশে এসে তিনি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সময় গড়িয়ে যায়, শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। যোগদান করেন মুক্তিযুদ্ধে।
এপ্রিল কি মে মাসে পাবনায় মিলিটারিরা বড়সড় এক অপারেশন চালায়। সেই অপারেশনে তার ইমিডিয়েট ছোটভাই অর্থাৎ আমার মেঝমামা পাক বাহিনীর হাতে নিহত হন। বড়মামা মাস তিনেক পাকিস্তানে থাকায় কিছুটা উর্দু শিখেছিলেন।
একটু উর্দু জানা থাকায় এবং সরকারি চাকরি শিক্ষকতা পেশায় থাকায় তার জীবন রক্ষা পায়।কিন্তু মেঝমামা মারা যাওয়ায় সে উন্মাদের মতো হয়ে যায় এবং তখনই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। বিজয় অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি আর চুল কাটেন নাই।
দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর মামা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতায়
ফিরে না গিয়ে 'বাংলাদেশ কঞ্জুমার্স সপ্লেয়ার্স'-এ চাকরি নেন এবং ১৯৭৫ সালে
প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাশ করেন।
সে বছর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে হঠাৎ করে 'কঞ্জুমার্স সাপ্লায়ার্স' কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে উপায়ন্তর না দেখে বিএ পাশ করা সত্বেও পুলিশের কনস্টেবল পদে ভর্তি হন। উদ্দেশ্য লেখাপড়া জানা ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ওপরে ওঠা। পদোন্নতি পেয়েছিলেনও। কিন্তু বাংলাদেশে সত্যনিষ্ঠতার মূল্য নেই।
সত্যবাদিরা স্বভাবতঃই একটু গোঁয়ার টাইপের হয়। মিথ্যা সহ্য করতে পারে না। ফলে দু-দু'বার পদোন্নতি পেয়েও প্রতিবারই নিকটতম উর্ধতন কর্মকর্তার মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কথার প্রতিবাদ করায় বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এবং সহ্য করতে না পেরে মেরে বসেন। ফলে পদাবনতি সহ চিরতরে পদোন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যায়।
এটাই ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সরকারের আচরণ! আজীবন মনে কষ্ট পুষে রেখে মনের দুঃখে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র সংগ্রহ করেননি এবং সরকারি ভাতাও ভোগ করেননি।