যুদ্ধাপরাধী প্রসংগ - লিখেছেন : ফজলুল বারী

 "পৃথিবীতে যখন রাষ্ট্র, গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, ন্যায়-নীতির বালাই ছিল না তখন ধর্ম আসে। আরব এলাকার লোকজন বেশি বর্বর ছিল বলে ইহুদি, খ্রিস্ট, ইসলাম এর মতো প্রধান তিনটি ধর্ম আসে ওই এলাকায়। এখনও ধার্মিকদের কাছে মানুষ ন্যায় ও সত্যের জয় আশা করে। 

 

কিন্তু বাঙালির অভিজ্ঞতা খুবই বাজে। মুসলমানরা কিভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সহায়তায় গনহত্যা ধর্ষণ সহ যাবতীয় অপরাধ চালাতে পারে এর ডকুমেন্টেশন হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। 

 

ওই সময়কার প্রধান কোন ইসলামিক নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। মাতৃভূমির স্বাধীনতার সশস্ত্র বিরোধিতা করে তারা যে অপরাধ করেছেন, অধর্মের কাজ করেছেন তা আজ পর্যন্ত স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চান নাই। 

 

দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত না থাকায় তারা আটকেপড়া পাকিস্তানিদের মতো এখানে থেকে যান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে তারা আবির্ভূত হন স্বরূপে। রাজনৈতিক আপোষকামীতায় দিনে দিনে তারা শক্তি অর্জন করেছেন। গড়ে উঠেছে তাদের বিশাল অনুসারী গ্রুপ। 

 

ধর্মীয় নেতারা অবলীলায় কিভাবে মিথ্যা বলতে পারেন এর অন্যতম দৃষ্টান্ত জামায়াতে ইসলামী। সশস্ত্র গ্রুপ গঠন করে দলটি বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছে। দেশ স্বাধীন হবার পরেও গোলাম আযম দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে যাতে কেউ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়। আজকের সমগ্র স্বাধীনতা বিরোধী প্রজন্ম এদের উত্তরসূরী। 

 

১৯৮৬-১৯৮৭ সালে আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমন শেষ হয়। আমি তখন বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের তৃনমূল পর্যায়ের নানান তথ্য জানতে পারি। তখন এমন স্মার্ট ফোন, ফেসবুক ছিল না। তখন এসব থাকলে আমার ডকুমেন্টেশন নিশ্চয় দেশের জন্য সম্পদ হতে পারতো। 

 

ভোলায় মোখলেসুর রহমান নামের এক রা-জা-কার ছিল। আমাকে দেয়া ইন্টারভিউ সে বলেছিল যখন দেশ যখন স্বাধীন হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধারা শহরে ঢুকে গেল আমি আমার ভাগনের বাড়িতে চলে গেলাম। ভাগনে আওয়ামী লীগ নেতা। সেখানে গিয়ে দেখি আমার মতো আরও অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন। ভাগনে বললো আপনাদের পেলে মানুষতো পিটিয়ে মেরে ফেলবে। এরচেয়ে ভালো আপনাদের জেলখানায় রেখে আসি। 

 

আমরা সেই থেকে জেলে থাকলাম। আল্লারে ডাকলাম। একদিন শেখ সাব মাফ করে দিলো। বেরিয়ে আসলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই যে শেখ সাহেব আপনাদের মাফ করে দিলেন, এ নিয়ে আপনার আজকের মূল্যায়ন কী? আস্তিন গুটালেন একাত্তরের রা-জা-কার মোখলেসুর রহমান! 

 

গলা চড়িয়ে বললেন, মাফ করবেনা মানে! আমাদের গায়ে হাত দেয় এমন সাহস কী শেখের ব্যাটার আছিলো নাকি! (ভোলার আঞ্চলিক ভাষা তার মতো করে লিখতে পারিনি)। এরাই হলো একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী রা-জা-কার যুদ্ধাপরাধী! দেশে তাদের ব্যাপক বংশ বিস্তার ঘটেছে। 

 

আমি ঢাকায় সাংবাদিকতায় ১৯৮৭ সাল থেকে। বিচিন্তার শেষের পাতায় “প্রজন্মের পরিভ্রমণ” নামে আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমন কাহিনী বেরুতো। এর বড় অংশ জুড়ে থাকতো মুক্তিযুদ্ধ। আমি তখনও সাংবাদিকতা নিয়ে পড়িনি। সেই শিক্ষাটা থাকলে আমার ডকুমেন্টেশনের কার্যক্রম নিশ্চয় অনেক সমৃদ্ধ থাকতো। 

 

যুদ্ধাপরাধী সাঈদিকে নিয়ে আমি লিখছি সেই ১৯৮৭ সাল থেকে। সংগ্রাম অফিসে গেলে আড্ডা হতো যুদ্ধাপরাধী কামারুজজামানের সংগে। আমাকে তিনি বোঝাতেন কেনো তাদের একাত্তরের ভূমিকা সঠিক ছিল। 

 

আমি তাকে বলতাম যাই বলুন না কেন এই যে গনহত্যা ধর্ষণের পক্ষে কোন যুক্তি নেই। যুদ্ধাপরাধী কামারুজজামান আমাকে থামিয়ে বলতেন না না আমি এসব করিনি। তিনি কি কি করেছেন তা আদালতে প্রমান হয়েছে। একাধিকবার ইন্টারভিউ করেছি মতিউর রহমান নিজামীর। অনেক সাধু সাধু ভাব ছিল এই যুদ্ধাপরাধীর! 

 

যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মৃত্যুর পর আমার পোষ্ট করা লেখাটি নতুন কোন লেখা নয়। এই সময়ে রি-পোষ্ট বলে তা অনেকের নজরে এসেছে। এমন সব মন্তব্য আসছিল যা প্রমান করে কোথাও কোন পড়াশুনা নেই! যেমন সাঈদিকে যখন আমি প্রথম ফোন করি সেটা ১৯৮৭ সালে ল্যান্ডফোনে। 

 

এখানে অনেকেই লিখছিলেন অসম্ভব, তখন ফোন ছিল না! এরা ফোন মানে মনে করে মোবাইল ফোন! তখন যে মোবাইল ফোন ছিল না, শুধু ল্যান্ডফোন ছিল এটাই এই প্রজন্মের জানা নেই! 

 

টুইন টাওয়ারে হামলার পর আমেরিকার নো ফ্লাই প্যাসেঞ্জারস লিস্টে বাংলাদেশের কারো নাম ছিল কিনা এটাতো ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করলেই জানা সম্ভব। 

 

সাঈদীর সর্বশেষ বিলাত সফরের সময় ব্রিটেনের চ্যানেল ফোরের রিপোর্টে কি ছিল, কেন তাকে বিলাতের সব মাহফিল বাতিল করে চলে আসতে হয়েছে এসবতো আজকের যুগের লোকজনের জানা কঠিন কিছু নয়। টুইন টাওয়ারে হামলা হয় ২০০১ সালে। 

 

এরপর সাঈদি কেন আর আমেরিকা যাননি, বিলাত থেকে বিদায়ের পর আর কেন এমন সব লাভজনক গন্তব্যে যাননি যেখানে তার মাহফিলের সব টিকেট অগ্রিম বিক্রি হয়ে যেত, এসবতো কঠিন গবেষনার বিষয় নয়। 

 

হযরত মোহাম্মদ(দঃ) সহ ইসলামের নবী-রাসুল কাউকে চাঁদে দেখা গেছে এমন কেউ কোনদিন কোন দেশে বলে নাই। বাংলাদেশের ধর্মভীরু মানুষকে এসব মিথ্যা বলে মানুষকে উত্তেজিত করে তান্ডব চালানো হয়েছে! 

 

তার মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে এসেছে তার বয়স! আগে শুধু বলা হয়েছে একাত্তরে শিশু ছিলেন! শুধু দাবি করা হয়নি তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! বন্দী অবস্থায় কারও মৃত্যু হলে লাশের পোস্টমর্টেম করাতে হয়। সাঈদীর ছেলেরা তাদের পিতার স্বাভাবিক মৃত্যুতে নিশ্চিত হয়ে তার লাশের পোস্টমর্টেম করাতে দেননি। এরপর যেভাবে উত্তেজনা ছড়ানো হলো এসবে মিথ্যার আশ্রয় এই যুদ্ধাপরাধীর শেষটা আরও বিতর্কিত করে রাখা হলো।

 

বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের অনুসারীদের মুখস্ত কিছু প্রশ্ন সবার জানা। ওমুক দলের ওমুকও রা-জা-কার বলেতো পালের গোদা বড়গুলোর অপরাধ কমেনা বা অনুজ্জ্বল হয়না। একাত্তরের সংগ্রাম পত্রিকায়তো যার তার নাম ছাপা হতোনা। 

 

এরা শুধু এখনও বলছেন না মীর মোশাররফ বিষাদ সিন্ধু লিখেছেন, এটা সত্য না। কারন তিনি কারবালার ময়দানে ছিলেন না! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত সত্যকে অস্বীকার করা প্রজন্ম যদিও দিনশেষে দেশেবিদেশে পরাজিত হয়। কারন বাংলাদেশটা দীর্ঘ সংগ্রাম আর রক্তাক্ত ইতিহাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কোন দুতাবাস বা ভাড়াটে লবিস্ট ফার্মের টাকায় কেনা দেশ বাংলাদেশ নয়। গোলাম আজম সাঈদি সহ সব যুদ্ধাপরাধীর প্রানের দেশের নাম পাকিস্তান।"

 

লিখেছেন: Fazlul Bari

 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url