হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণের ইতিবৃত্ত

‘আজকের এই লেখায় তুলে ধরবো, হাদীস সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও এর শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কিত তুঘলকি কান্ডকারখানা নিয়ে এবং এর নির্মম বাস্তবতা নিয়ে কথা বলবো পর্যায়ক্রমে’।

মুস্‌নাদে আহ্‌মাদ বিন হাম্বাল

কোরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্পূরক সহায়ক ইত্যাদি বিভিন্ন নামে লোকমুখে শোনা হাদীসকে ইসলামী শারীয়ার উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা, অতঃপর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো হাদীসের দখলদারিত্বের কাছে কোরআনের অসহায়ত্বের বিবরণ অনেকেই জানেন। কেউ প্রকাশ করেন, কেউ ‘ব্যাবসায়িক’ কারণে সাধারণের কাছে চেপে যান।

 

কোরআন যে আল্লাহর বাণী তা কিভাবে বুঝবো’ - আরবের লোকেরা এমন প্রশ্ন বারবার করেছে নবীজীকে। আল্লাহ এর উত্তরে বলেছেন; “তবে তাদের এমন একটি আয়াত আনতে বলো, যদি তারা সত্যবাদী হয়”-(৫২:৩৪)।

 

আমরা অনেকেই মনে করি, কোরআনের মতো একটি আয়াত বানানো যাবে না কেনো! কেনো যাবে না তা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে বানানো যায়নি। গত দেড় হাজার বছরে অনেক বৈশিক পরাশক্তি কোরআনে নতুন নির্দেশ যুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। ১৫০০ বছরের এই বিশ্ব পরিক্রমায় বিভিন্ন পরাশক্তির আপ্রাণ প্রচেষ্টা সত্বেও আল্লাহর কিতাবের একটি অক্ষরও কেউ বদলাতে পারেনি।

 

ইসলামের ভিতরে বাইরে হাজারও দলমত, পক্ষ-বিপক্ষ কেউ কোরআনের একটি শব্দ নিয়ে ভিন্নমত করেনি। হাদীস কোরআনের মতো ওহী হলে চেংগীস, গজনী, হিটলার, মুসলিনীর পক্ষেও একটি জাল হাদীস বানানো সম্ভব হতো না। দেওয়ানবাগী, আরামবাগী যে কারো পক্ষে মনগড়া তাফসির লেখার সাধ্য হতো না।

 

ডক্টর ইয়াসির কাদির এক বক্তৃতায় বলেছেন , ‘হাদীস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে তারা মূর্খ'। হাদীসের সত্যতা নির্ণয়ের নাকি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি আছে, যা তিনি মদিনা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন’। যদিও এই বিজ্ঞান তেহরান ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে আছে। দুই ইউনিভার্সিটির সহী হাদীসের তালিকা আলাদা। 

শরীয়তের বিধান হিসাবে লোকোমূখে শোনা হাদীসকে কোরআনের সমকক্ষ মনে করা কতখানি যৌক্তিক তার উত্তর এই লেখার শেষে মিলবে ইনশাল্লাহ।

 

হাদীস ও ইতিহাস পাঠে আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু কোনো ঐতিহাসিক বা কোরআন অন-নুমোদিত সুত্রে প্রাপ্ত তথ্য শরীয়তের বিধান বা আইন নয়। হাদীস সংগ্রহ, সংরক্ষনের সামান্য ধারণা দেই, তাতেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন, হাদীস কতো প্রকার ও কি কি! হাদীসের নামে দিনশেষে আমাদের কি কি গেলানো হচ্ছে। 

 

এখানে যে তথ্য দিচ্ছি তা আপনি আপনার পছন্দের শায়খের মাধ্যমে চেক করে নিতে পারেন। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার অধিকার আপনার আছে।

 

নবীজীর জীবদ্দশায় বিক্ষিপ্তভাবে হাদীস সংরক্ষণ করা হয়। অর্থাৎ যারা নবীজীর সাথে সার্বক্ষণিক থাকতেন তারা নবীজীকে যা করতে দেখেছেন, বা বলতে শুনেছেন তা বিশেষভাবে মনে রেখেছেন বা কিছু কিছু লিখেও রেখেছেন।

'আপনি যদি হোয়াইট হাউজের প্রেসিডেন্টের সাথে ডিনারের সুযোগ পান, আপনার সে ঘটনা লিখে রাখতে হবে না। আপনি সারাজীবনই গল্প করে বেড়াবেন'।

 

নবীজীর বিশিষ্ট সাহাবীরা নবীজীর প্রতিটি আচার আচরণ বিশেষভাবে খেয়াল রাখতেন এবং নবীজীর সাহচর্যে থাকার অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। যাদের অনেক বেশি হাদীস জানা ছিলো তাদের কাছে হাদীসের তালিম নিতে অনেকেই দূর-দুরান্ত থেকে আসতেন। কিন্তু নিজেকে নবীজীর খুব ঘনিষ্ট লোক বোঝাতে অনেকেই বানিয়ে বানিয়ে হাদীস বলা শুরু করে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সার্থেও নবীজীকে উদ্ধৃত করা হয়। এভাবে নানান কথাবার্তা যে যার মতো বলতে থাকে। লোকমুখে লক্ষ লক্ষ হাদীস ঘুরতে থাকে।

 

হাদীস সগ্রহ ও সংকলনঃ

সর্বপ্রথম ইমাম মালেক হাদীস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সফল ও আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেন। তিনি মদীনার অধিবাসী ছিলেন। ৯৩ হিজরীতে অর্থাৎ নবীজীর ইন্তেকালের ৮৩ বছর পর তার জন্ম। তার জীবদ্দশায় বেশ কয়েকজন সাহাবী জীবিত ছিলেন যাদের কাছ থেকেও তিনি হাদীস সংগ্রহ করেছেন।

তিনি নিজে তাবেঈ বা দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলিম ছিলেন এবং তার সংগৃহীত বেশিরভাগ হাদীসের বর্ণনাকারীই তাবেঈ ছিলেন। তার সংকলিত হাদীসগ্রন্থ “মুয়াত্তা মালেকের” ভুমিকায় তিনি লিখেছেন, তিনি প্রায় ১ লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করেছেন। এই ১ লক্ষ হাদীস থেকে যাচাই বাছাই করে তিনি ১৮০০ হাদীস তার মুয়াত্তা’য় স্থান দিয়েছেন। যার অর্থ হচ্ছে, প্রায় ৯৮ হাজার হাদীস তিনি ‘গার্বেজ’ করে দিয়েছেন। এ হাদীসগুলো তারকাছে মিথ্যা বা বানোয়াট মনে হয়েছে। এই ৯৮ হাজার হাদীস তিনি কার্যত অস্বীকার করেন। অর্থাৎ তিনি ‘মুনকারিনে ৯৮ হাজার হাদীস’ বা ৯৮ হাজার হাদীস অস্বীকারকারী।

 

নবীজীর ইন্তেকালের প্রথম শতকেই সাহাবী, তাবেঈদের যুগে খোদ মদীনাতেই যদি ১৮০০ হাদীসের বিপরীতে লক্ষাধিক বানোয়াট কথা রটতে পারে, সলফে সালেহীনরাই রটাতে পারে,- তাহলে ১৫০০ বছর পর ৫০০০ কিলোমিটার দূরের অবস্থা কি হতে পারে তা অনুমান করতেই পারেন।

 

হাদীস এবং ফিকাহ্‌র উপর ইমাম মালেকের পান্ডিত্য প্রশ্নাতীত। তবে ইমাম মালেক অনেক হাদীস নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি মুয়াত্তা’য় উল্লেখিত অনেক হাদীস তিনি তার নিজের ফিকহ্‌ মাসালায় বিবেচনায় নেননি। তিনি এসব হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ হাদীসগুলি আমি গ্রহণ করেছি, কিন্তু এগুলোর উপর আমরা আমল করিনা। কারণ, এগুলো কোরআনের বক্তব্যের বা কোরআনের মূলনীতির পরিপন্থী’।

এই হাদীসগুলো আমল না করলে আপনি গ্রহণ করলেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ হাদীসগুলো আমি জেনে বুঝেই বাতিল করেছি এটা বোঝানোর জন্যই আমি মুয়াত্তা মালেকে উল্লেখ করেছি। নইলে অনেকেই মনে করতো, আমি হয়তো এই হাদীসগুলো জানিনা বলেই এমন ফতোয়া দিয়েছি’।

 যেমন, 'কুকুর কোনো পাত্রে মুখ লাগালে তা ৭ বার ধুয়ে নিতে হবে'- এমন একটি হাদীস ইমাম মালেক মুয়াত্তায় উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এ হাদীস তিনি অকার্যকর বলেছেন। কারণ কোরআন কুকুরকে অপবিত্র বলেনি। 

ইমাম আবু হানিফাও কুকুরের বিধানকে অন্যান্য প্রাণীর মতোই বলেছেন। অর্থাৎ কুকুরের বেলায় যে বিধান প্রযোজ্য তা অন্যান্য প্রাণীর বেলাতেও একই।

 

এবারে মুয়াত্তা মালেকের ১৮০০ হাদীসের বিবরণঃ

মুয়াত্তা মালেকে সংকলিত ১৮০০ হাদীসের মধ্যে মাত্র ৬০০ হদীস আছে মারফু হাদীস। মারফু হাদীসই হাদীস বলতে আমরা যা বুঝি। অর্থাৎ নবীজীর কথা, কাজ, অনুমোদন। ৬০০ হাদীস আছে মউকুফ হাদীস। এ হাদীসগুলোর সাথে নবীজীর কোনো সম্পর্কই নাই। এগুলো হচ্ছে সাহাবীদের কথা, কাজ, অনুমোদন। নবীজীর সাহাবীদের সংখ্যা কয়েক লক্ষ। সাহাবী মানে নবীজীকে যারা সরাসরি দেখেছেন।

 

মদীনায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর এবং মক্কা বিজয়ের পর অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে, সাধারণ ক্ষমা পেতে বা ‘সরকারি দলের’ সুযোগ সুবিধা নিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে যারা প্রকৃতপক্ষে মুসলিম ছিলো না। কোরআনে মুনাফেকদের নিয়ে একটি সুরা’ই আছে। মুনাফেকদের সম্পর্কে বহু আয়াত আছে।

সুরা তওবা : আয়াতে ৯৭ - আল্লাহ বলেছেন, “আরবরা কুফর ও মুনাফেকীতে কঠিনতর”। একই সুরার আয়াত-১০১ “তোমাদের আশেপাশে মরূবাসীদের মধ্যে কিছু লোক মুনাফেক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কিছু লোক অতি মাত্রায় মুনাফেকীতে লিপ্ত আছে। তুমি তাদেরকে জানোনা, আমি তাদেরকে জানি”।

 

সুতরাং নবীজীর সময়ে অনেক ছদ্দবেশী মুসলমান ছিলো। কিন্তু আমরা জানিনা তারা কারা! নবীজীর মৃত্যুর পর এরা ধর্ম ত্যাগ করে। হজরত আবু বক্কর(রাঃ)’র খেলাফতকালে এ ধর্মত্যাগীদের সাথেই রিদ্দার যুদ্ধ হয়।

 

নবীজীর সকল সাহাবীদের কথা, কা্জ, অনুমোদনও কি শরীয়তের বিধান? হযরত জায়েদ (রাঃ) ছাড়া আর কোনো সাহাবীর নামই নাই কোরআনে। অথচ তাদের কথা, কাজ, অনুমোদন কোরআনের সমকক্ষ হয় কোন বিবেচনায়?

 

এখানেই শেষ নয়। প্রায় ২৫০ টি মাকতু হাদীস আছে মুয়াত্তা’য়। মাকতু হাদীস হচ্ছে তাবেঈদের কথা, কাজ, অনুমোদন। তাবেঈদের সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন। ইয়াজিদ, সীমার এরাও তাবেঈ ছিলো।

 

যেখানে স্বয়ং ইমাম মালেক সাহাবী, তাবেঈদের বর্ণিত ৯৮ হাজার হাদীস গ্রহন করেননি। যার অর্থ সকল সাহাবী ও তাবেঈ সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ছিলেন না। সেখানে তাবেঈদের কথা, কাজ, অনুমোদনও কি করে কোরআনের মতো শরীয়তের বিধান হয়?

 

মুয়াত্তা’য় প্রায় ২০০ হাদীস আছে মুরসাল। আরবীতে ‘বোমবার্স্টিক’ শোনালেও মুরসাল শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিত্যায্য। কারণ, এসব হাদীসের বর্ণনাকারী নবীজীর মৃত্যুর পর জন্মগ্রহণ করেছেন। এরা লোকমুখে এসব হাদীস শুনেছেন। কিন্তু কোন লোকের কাছ থেকে শুনেছে তা সঠিক মনে নেই।

 

যে ৬০০ মারফু বা নবীজীর হাদীস আছে মুয়াত্তা’য়, তারও পূনরাবৃত্তি আছে অনেক। ইউনিক হাদীস হিসাব করলে  শ’তিনেক প্রকৃত হাদীস আছে মুয়াত্তায়।

 

হদীসের এই জটিল শ্রেণীবিন্যাস আমরা কতোজন বুঝি! আমরা শুধু বুঝি বা আমাদের বোঝানো হয়, মুয়াত্তা মালেকের হাদীস, সহীহ বুখারীর হাদীস, বা সহীহ ইবনে হিব্বানের বর্ণনা – এটুকুই।

 

ইমাম আবু হানীফাঃ

হিজরী ৮০ সালে জন্মগ্রহণকারী সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী স্কলার ইমাম আযম আবু হানীফা বয়সে ইমাম মালেকের চেয়ে ১৩ বছরের বড়। সমসাময়িককালের মানুষ হলেও হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এই দুইজন জগৎ বিখ্যাত ইসলামী পন্ডিতের দ্বিমত স্পষ্ট। এই দ্বিমতের কারণেই ‘হানাফী’ ও ‘মালেকী’ দুটি ভিন্ন মাযহাবের সৃষ্টি হয় ইসলামের প্রথম শতকেই। 

হানাফী মাযহাব মোতাবেক রক্ত বের হলে ওজু ভংগ হবে। কিন্তু মালেকী মাযহাব মোতাবেক হবে না। এবার ওজুর সাথে নামাজের সম্পর্ক। ওজু নাই মানে হানাফী মতে নামাজ হবে না। কিন্তু মালেকী মতে হবে। এবার কোনদিকে যাবেন?

 

‘এমন অসংখ্য দ্বিমুখী পথ আছে যার মূল কারণ লোকমুখে শোনা হাদীস। ইমাম মালেক আর আবু হানীফার মতো মহাপন্ডিতেরা একমত হতে পারেননি কোনটা নবীজীর হাদীস আর কোনটা বানোয়াট কথা। যেখানে সাহাবী তাবেঈরা সত্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। সেখানে আমি আপনি বলবো, এটা সহীহ হাদীস আর এটা সহী নয়’!

 

ইমাম হাম্বলঃ

হিজরী ১৬৪ সালে ইমাম আহাম্মদ ইবনে হাম্বলের জন্ম বাগদাদ, ইরাক; যিনি ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালেকের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু তার সংকলিত “মুসনাদ আহমদ ইবনে হাম্বলে” প্রকাশনী ভেদে প্রায় ২৭ হাজার থেক ৪০ হাজার হাদীস আছে। বলাবাহুল্য মুসনাদ আহমদে’র অন্তত ৮০ ভাগ হাদীস ইমাম আবু হানীফা এবং ইমাম মালেক হাদীস বলেই গন্য করেননি। নিজেদের কিতাবে স্থান দেননি, নিজেদের ফিকহ্‌ মাসালায় বিবেচনায় নেননি। ইমাম হাম্বল তার ওস্তাদ ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালেকের পরিত্যক্ত হাদীস নিয়ে সুন্নী ইসলামের ৩য় ‘লিমিটেড কোম্পানি’ হিসেবে হাম্বলী মাযহাব খোলেন।

 

ইমাম শাফেয়ীঃ

ইমাম শাফেয়ী বয়সে ইমাম হাম্বলের ১৬ বছরের বড়। তিনিও ইমাম মালেকের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু বলাবাহুল্য, তার সহী হাদীসের তালিকা তার সমসাময়িক ৩ জন জগৎ বিখ্যাত পন্ডিতের থেকে ভিন্ন ছিলো। সংগত কারণেই সুন্নী ইসলামের ৪র্থ ‘লিমিটেড কোম্পানি’ হিসেবে “শাফেয়ী মাযহাব” জন্ম নেয়।

 

এই ৪ টি প্রধান মাযহাব ছাড়াও অসংখ্য রেজিস্টার্ড আন-রেজিষ্টার্ড,- ক্ষুদ্র, মাঝারী 'লিমিটেড কোম্পানি' আছে ইসলামে। যার প্রধান পুঁজি, ‘এই হাদীস সহীহ, এই হাদীস জাল’।

মুয়াত্তা মালেক, মুসনাদ আহমাদ, ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম শাফেয়ীর তালিকার বাইরেও লক্ষ লক্ষ হাদীস বিক্রী হচ্ছে কালো বাজারে। যে যার মতো গল্প তৈরি করছে, দল-উপদল বানাচ্ছে।

 

ইমাম বুখারীঃ

ইমাম বুখারী পর্যন্ত দৃশ্যপটে পরিবর্তন আসে।

হিজরী ১৯৪ সালে উজবেকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী ইমাম বুখারী সর্বকালের অন্যতম সেরা মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি বিশেষ মানদন্ড অনুযায়ী কেবল সহীহ হাদিসের গ্রন্থ প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। অর্থাৎ তার কিতাবে শধু সহীহ হাদীসই স্থান পাবে।

 

কথিত আছে তিনি প্রায় ৬ লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করেছেন। এরমধ্যে সহীহ বিবেচনায় মাত্র ৭ হাজার হাদীস বুখারী শরীফে স্থান পেয়েছে। অর্থাৎ ইমাম বুখারী প্রায় ৫ লক্ষ ৯৩ হাজার হাদীস বাতিলের খাতায় ফেলেছেন যাতে অন্যান্য ইমামদের তালিকাভুক্ত কয়েক হাজার সহীহ হাদীস আছে।

 যদি বুখারী শরীফের বাইরে আর কোনো সহীহ হাদীস নাই থাকে, তবে বুখারী শরীফ ছাড়া আর কোনো হাদীস গ্রন্থের প্রয়োজন পড়তো না। তাহলে ইমাম বুখারীও মুনকারিনে হাদীস।

বুখারী শরীফের ৭ হাজার হাদীস থেকে পুনরাবৃত্তি বাদ দিলে ইউনিক হাদীস মাত্র ২২৩০ টি। এর সবগুলো আবার মারফু বা নবীজীর বিবৃত নয়।

 

ইমাম বুখারীর হাদীসের সত্যতা যাচাইয়ের যে পদ্ধতি ছিলো তা ছিলো মূলতঃ ইস্তেখারা বা ধ্যান। ধ্যান বা স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত কি বিজ্ঞানসম্মত বা গ্রহনযোগ্য এভিডেন্স? ধ্যান বা স্বপ্নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু কারো স্বপ্নে দেখা সাক্ষ্যের উপর কোনো বিচারিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়?

 

ইমাম মুসলিমঃ

একই সময়ে ইমাম মুসলিমও একই পদ্ধতিতে সহীহ হাদীসের গ্রন্থ প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজী এবং ইমাম নাসাঈ ৩ জনই ইমাম বুখারীর ছাত্র ছিলেন। কিন্তু ৪ ইমামের সহীহ হাদীসের তালিকা ৪ রকম।

 

অনেক স্কলার মুসলিম শরীফকে কোরআনের পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ গ্রন্থ মনে করেন। কেবলমাত্র সহীহ হাদীসের সংকলন বিধায় বুখারী ও মুসলিম শরীফের শুরুতে 'সহীহ' শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়। কিন্তু সহীহ মুসলিমের প্রায় ১২ হাজার হাদীস আছে যাতে প্রায় ৪ হাজার ইউনিক হাদিস।

তাহলে একই সময়ে একই অঞ্চলের সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম দুইজন মুহাদ্দিসের সংকলিত হাদীসে অমিল কেনো?

 

ইমাম মুসলিম প্রায় ৬০০ রাবীর হাদীস গ্রহণ করেছেন, যাদের ইমাম বুখারী বিশ্বস্ত বলে গন্য করেননি। এই ৬০০ বর্ণনাকারী যদি একটি করেও হাদীস বর্ণনা করে তাহলে অন্তত ৬০০ হাদীস আছে যা ইমাম মুসলিমের মতে সহীহ, কিন্তু তার ওস্তাদ ইমাম বুখারী বেমালুম বাতিল করে দিয়েছেন।

 বিদায় হজ্জ্ব ও গাদিরেখুমের হাদীসগুলো মুসলিম শরীফে সহীহ সনদে বিবেচিত হলেও বুখারী শরীফে সে হাদীস নাই। নাই মানে এ হাদীস ইমাম বুখারী শোনেননি এমন নয়। তিনি এই হাদীসগুলোকে সত্য বলে গন্য করেননি। তাহলে আমরা কার কথা শুনবো!

 

ইমাম তিরমিজীঃ

ইমাম বুখারীর আরেক ছাত্র ইমাম তিরমিজী তার সংকলিত ‘তিরমিজী শরীফে’ মাত্র ৩৬০০ হাদীস তালিকাভুক্ত করেছেন। তিরমিজী শরীফ শুধুমাত্র সহীহ হাদীসের সংকলন নয়। অর্থাৎ তিরমিজী শরীফের সব হাদীসকে হাদীস বিশারদরা সহীহ বলে বিবেচনা করেননি। তিরমিজী শরীফে সহীহ বুখারী ও মুসলিমের কয়েক হাজার হাদীসের জায়গা হয়নি।

 

ইমাম নাসাঈঃ

ইমাম নাসাঈ ৫৭৫৮ টি হাদীস তার “নাসাঈ শরীফের” জন্য বিবেচনায় নিয়েছেন। কিন্তু এ হাদীসগুলোর মধ্যেও পুনরাবৃত্তি বা সহীহ নয় এমন হাদীস বাদ দিলে এর সংখ্যা হবে অর্ধেকেরও কম। ইমাম নাসাঈও ইমাম বুখারীর ছাত্র ছিলেন। কিন্তু হদীসের সত্যতা নির্ধারণে ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী, নাসাঈ সমসাময়িককালের শিক্ষক-সতীর্থ এবং সর্বকালের সেরা এই ৪ জন হাদীস সংকলক একমত হতে পারেননি।

 

জগতশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ ইমাম মুসলিম ৬-৭ লক্ষ হাদীস যাচাই বাছাই করে ১২ হাজার সহীহ হাদীসের যে তালিকা করেছেন, তার সতীর্থ ইমাম তিরমিজী ও ইমাম নাসাঈ ও শিক্ষক ইমাম বুখারী সে তালিকার কয়েক হাজার হাদীসকে হাদীস বলেই গন্য করেননি।

 

সুনানে আবু দাউদ, ইবনে মাজা ও অন্যান্যঃ

সুনানে আবু দাউদে প্রায় ৫ হাজার, ইবনে মাজায় হাদীস আছে ৪ হাজার ৩০০।

জর্ডানের নাসির উদ্দিন আলবানীর “সিলসিলা আহাদীস”, সিরিয়ার ইমাম নববীর “রিয়াদুস সালেহীন”, ইরানের ইমাম বাগাভী ও ভারতের দিল্লীর শায়খ ওয়ালিউল্লাহর যৌথভাবে সংকলিত “মিশকাতুল মাসাবীহ”, মিশরের ইবনে হাজার আস্কালানীর “বুলুগাল মারাম” - এই হাদীস গ্রন্থগলো মৌলিক নয়। বিভিন্ন মৌলিক হাদীস গ্রন্থ থেকে তারা তাদের বিবেচনায় সহীহ, এমন হাদীসগুলো তালিকাভুক্ত করেছেন।

 

এমন সহস্রাধিক নাম না জানা হদীসগ্রন্থও আছে। এগুলোতে সদীহ হাদীসকে জাল বানিয়ে তা বেদাত, আবার জাল হাদীসকে হাসান বা মুরসাল বানিয়ে তা আল-হাদীস হিসাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে। এই সহীহ বা জাল হাদীস শুধু হিজাব-নিকাব, দাড়ি-মৌছেই শেষ নয়, হাদীসেই কতো কতো সাম্রাজ্যের উথান-পতন, কত বৃথা রক্তপাত তার হিসাব নাই।

 

ইবনে তাইমিয়ার অনুমোদিত হাদীস ও মতাদর্শের ভিত্তিতে সালাফি ও জেহাদী ধারার ওহাবী আন্দোলন গড়ে তোলেন মওলানা মোহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব। সৌদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ বিন সউদের সাথে ইবনে ওয়াহাবের ধর্মীয়-রাজনৈতিক জোট তৈরি হয়। বৃটিশরা ওসমানী খেলাফতকে উতখাতের জন্য এই জোটকে আর্থিক সহায়তা দেয়। মুসলিম খেলাফতের সাথে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য শক্তিশালী ফতোয়া লাগবে। ওহাবী মুফতিরা ওসমানী খেলাফতকে শিরক, বেদাতে লিপ্ত কাফের, মুরতাদ ফতোয়া দেয়। কারণ খেলাফতের সময় সৌদি আরবে সাহাবী, তাবেঈ ও সুফী সাধকদের অসংখ্য মাজার ছিলো। প্রসিদ্ধ সুন্নী মাযহাবের প্রচলন ছিলো। এই মাজার মাযহাব মানে ওহাবী দর্শন মোতাবেক শিরক। আর শিরকের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে হবে। ইসলামী খেলাফতের বিরুদ্ধে ওহাবীদের ফতোয়া আর পশ্চিমা সামরিক শক্তির কাছে ১৯২৪ সালে ইসলামের ইতিহাসের সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল মজিদের পতনের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় হাজার বছরের ইসলামী খেলাফত।   

 

হযরত ফাতেমা(রাঃ), হযরত ওসমান(রাঃ) সহ শতশত সাহাবী তাবেঈর মাজার ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয়। শতশত ইসলামী স্কলারকে হত্যা করা হয় ওহাবী মুফতিদের শরিয়া আইনে। বৃটিশরা মধ্যপ্রাচ্যে ঘাটি গাড়ে। আস্তে আস্তে আরব ভুখন্ডে ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।

 

বৃটিশের পর আমেরিকার পুতুল ও পশ্চিমা মিত্র হিসেবে টিকে আছে সৌদি ওহাবী কথিত বেদাত বিরোধী সরকার। আল আযহার, তেহরান ইউনিভার্সিটির স্কলাররা এই ওহাবী মতবাদকে “শয়তানের দর্শন” বলে আসছে। কোনো এক সময় ওহাবী বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে মক্কা-মদীনার বড় বড় শায়খদের শিরোচ্ছেদ করা হতে পারে মুরতাদ হিসাবে!

 

হাদীস অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইসলামী স্কলারকে মুরতাদ বা মুনাফেক বানিয়ে ফাসি দিতে পারবেন! হাদীস শুধু দাড়ি-মৌছেই শেষ নয়। হাদীস অপব্যবহারের অসংখ্য কাহিনী লাখো মুসলমানের রক্ত আর চোখের জলের কাহিনী লেখা আছে ইসলামের ইতিহাসে। হাদীস অনুযায়ী যে কাউকে কাফের ফতোয়া দিয়ে শিরোচ্ছেদ করা যায়!

 

আহলে হাদীসের লোকেরা তাবলীগ জামাত ও মাজারের ঘোর বিরোধী। জামাতের বিরোধিতা কেবল সরকারের নেক নজরে আসার কৌশল।

হাদীস অনুযায়ী ‘তাবলীগ জামাতের লোকদের হত্যা করে আদ সামুদের মতো নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে’ - শায়খ আব্দুর রাজ্জাকের এক ভিডিওতে এমন হুংকার শোনা গেছে। আর মাজার দরগাকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে, কারণ এগুলো শিরকের আখড়া।

 

বাংলাদেশের সব দরগা-মাজারে শিরক বেদাতী ও অনৈসলামিক কাজকর্ম হচ্ছে, এটা মাজারের পৃষ্ঠপোষক “আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের” লোকেরাও মানে। তবে এই শিরক বন্ধ করা সম্ভব। 

বাংলাদেশে একটি ধর্ম মন্ত্রনালয় আছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন আছে। তারা ঐতিহাসিক নথিপত্রবিহীন ভুঁইফোর মাজার বন্ধ করে প্রকৃত ওলি-আওলিয়াদের দরগা বা মাজারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে পারে। জান্নাতুল বাকির মতো পুলিশি ব্যবস্থা নিলে মাজার থেকে গাঁজার আসর তুলতে দুইদিনও লাগবে না। 

 

সেখানে আগত দর্শনার্থীদের অনৈসলামিক কর্মকান্ড সম্পর্কে সচেতন করার জন্য বা মাজারের আচরণবিধি প্রশিক্ষণ দিতে বিশেষজ্ঞ আলেমদের সমন্বয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি করা যাতে পারে।

সেখানে মানুষ দান করলে তা দিয়ে গবেষনা বা জনকল্যানমূলক কাজে ব্যয় করা যেতে পারে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন দায়িত্ব নিলে মাজারে অনৈসলামিক কাজ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

কিন্তু মাজারের পক্ষে-বিপক্ষে দুইদল লড়াই করছে। কেউ কোনো সমাধান দিচ্ছে না। একদল বলছে মাজার মানে শিরক, তাই মাজার তুলে দিতে হবে। আরেক দল মাজার রক্ষার্থে জীবন দেবে!

 

না, মাজার তুলে দিলেই শিরক বন্ধ হবে না। এগুলো একান্তই শিশুতোষ কথাবার্তা। শিরক করার জন্য আব্দুল কাদের জিলানীর মাজার কোথায় তাও জানার প্রয়োজন নাই। কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, হযরত জিলানী আজরাইল(আঃ)কে থাপ্পর মেরে মৃতকে জীবিত করেছে বা ওজু ছাড়া ওনার নাম নিলে ৪০ টা পশম পড়ে যাবে; তবে সে আবু জাহেলের মতোই মুশরিক। আপনি হযরত জিলানীর মাজার বন্ধ করতে পারবেন, মানুষের ‘মনে করাকে’ বন্ধ করবেন কিভাবে?

 

তাবলীগের লোকেরাও অনেক ভালো ভালো কাজ করছে। তবে তাবলীগের বড় বড় মুরব্বীরা সাধারণতঃ ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ব্যাংকের ম্যানেজার, গণিতের অধ্যাপক। ধর্ম সম্পর্কে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নাই। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান থাকাটা আবশ্যকও নয়।

তবে তারা মুলত ফাজায়েলে সিরিজের বইয়ের ভিত্তিতে কিছু দোয়া-আমল শেখে এবং দিনরাত সে সব আমল করে। তাদের ফাজায়েলে আমলে কোরআন হাদীসের চেয়ে জনৈক মুরব্বী বুজর্গদের কথাই বেশি। এখন মুরব্বীদের কথাগুলো কেউ ‘মুরব্বীদের’ কথা হিসেবে নিলে আর কোনো সমস্যা নাই।

 

বাংলাদেশের প্রবীন শায়খুল হাদীসরা তাবলীগ জামাতের ফাজায়েল সিরিজের মতোই ৯ খানা প্রসিদ্ধ হাদীসের কিতাব পড়ে দাওরায়ে হাদীস পাশ করে। এরপর ৪০ বছর বুখারীই পড়ায়। এই ফাজায়েলে আমলের মতো হাদীসকেও হাদীস হিসেবে নিলে সমস্যা নাই। কিন্তু কোরআন বহির্ভুত হাদীস শরিয়া নয়, হতে পারে না।

 

মৌলিক ও সংকলিত হাদীসের প্রকাশনাভেদেও পার্থক্য আছে। এজন্য হাদীসের রেফারেন্স দেয়ার সময় প্রকাশনা সংস্থার নামও বলতে হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং এমদাদিয়া লাইব্রেরির মুসলিম শরীফের গড়মিল আছে।

আনুবাদে ভিন্নমত আরো বেশি। অনুবাদকারী নিজেদের মাযহাব সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অর্থ ঘুরিয়ে দেয়। তবে হাদীসের অনুবাদক অবশ্য কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়। আর শুধু অনুবাদ থেকে তো বুঝবেন না! হাদীসেরও আবার ব্যাখ্যা লাগবে।

ইবনে হাজার আস্কালানীর “ফাতহুল বারী” বুখারী শরীফের প্রসিদ্ধ তাফসির। এসব তাফসিরের মাধ্যমেই তিল কে তাল, তাল কে তিল গাছ বানানো হয়েছে।

 

ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাংগীর সাহেবের “হাদীসের নামে জালিয়াতি” বইয়ে জাল হাদীসের যে তালিকা প্রকাশ করেছেন তাতে অনেকেরই অনেক সহীহ হাদীস আছে। যে কারণে বেঁচে থাকতে তার প্রচুর বিরোধিতা ছিলো। অনেকেই তার বই পড়তে নিষেধ করতেন। সহীহ হাদীসকে জাল বলার জন্য ‘মুনকারিনে হাদীস’ ফতোয়াও পেয়েছন।

 

বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজা, মুসনাদ আহমাদ, দারেমী হাকীম, হিব্বান, বায়হাকীতে একই হাদীস আছে বহুবার। কিন্তু সিংগেল ‘ফ্যাক্ট এন্ড এক্ট’ অনুযায়ী দুনিয়ার সব হাদীসগ্রন্থ মিলিয়ে ইউনিক হাদীস আছে সাড়ে ৪ হাজার। এই সাড়ে ৪ হাজারের মধ্যে সর্বসম্মতিক্রমে সহী, এমন হাদীস আছে ২৮০০ থেকে ৩২০০। এরমধ্যে মওকুফ আর মাফতু বাদ দিলে, মারফু হাদীস বা নবীজীর কথা, কাজ, অনুমোদনের হাদীস আছে ২ হাজারেরও কম। এই হাদীসগুলোর বেশিরভাগই কোরআনের আয়াতেরই পুনরাবৃত্তি। কোরআন মানলে সেই হাদিসগুলো মানা হয়েই যাচ্ছে। ‘গোসল করলে বোনাস হিসেবে ওজু তো হয়েই যাচ্ছে'।

 

সর্বোচ্চ কয়েক’শ হাদীস পাবেন এই তালিকায় যা কোরআনে নাই। যার আকার বড়জোড় কোরআনের ৩ থেকে ৪ পারার সমান হবে। এই দুই-তিন’শ হাদীসের জন্য ইসলাম ধর্ম অচল হয়ে গেলো! হাদীস ছাড়া ইসলামের আর কিছুই থাকে না!

 

আমরা হুজুরদের কাছে কান খোঁচানোর মাসালা জিজ্ঞেস করি আর মনে করি আহা, হুজুর কতো হাদীস ঘেটে উত্তর দিচ্ছেন! না, যে প্রশ্নের উত্তর কোরআনে নাই, তা হাদীসেও নাই। হুজুর উত্তর দিচ্ছেন, দিতে হচ্ছে তাই। নইলে আবার বলবেন, হুজুর কিছু জানে না।

যখন হাদিস জানতে যাবেন, তখন আবার বলবে মাযহাব লাগবে। কারণ হাদীসেও সব প্রশ্নের উত্তর নাই।

 

ফেসবুকে জুমার খুতবা শোনা জায়েজ না নাজায়েজ এ প্রশ্নের উত্তর কোন ইমামের বইয়ে পাবেন? তাহলে কিয়াস বা অনুমান করতে হবে। এ অনুমান কোরআনের ভিত্তিতেই করা যায়। কোরআনে সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন না! কিন্তু উমাইয়া আব্বাসীয় সরকারের আইন হিসাবে প্রণীত ফিকহ্‌ ও তার রেফারেন্স হিসাবে সন্নিহিত হাদীস যে ইসলাম ধর্মের বিধান নয়, তা আপনাকে অনুমান করতে হবে না।

 

ইসলাম ধর্মের সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ এবং একমাত্র অনুমোদিত বিধান যে কোরআন তা কোরআন পরিস্কার করেই বলেছে।

যাদের ধারণা হাদীস ছাড়া কোরআন বোঝা সম্ভব নয় বা নবীর সুন্নত সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়, তারা কোরআন এবং হাদীস কোনোটাই বোঝার উদ্দেশ্যে পড়ে দেখেননি। তিনি যে কথাটা বলছেন তা কোনো হুজুর তাকে বলেছে। সে হুজুরকে বলেছে তার হুজুর।

 

কোরআন খুললেই দেখবেন হযরত আদম(আঃ) থেকে হযরত মোহাম্মদ(সাঃ) পর্যন্ত সব নবীদের সিরাত, সুন্নত, হাদীস আল্লাহ নিজেই বর্ণনা করেছেন। এ কারণেই আল্লাহ আমাদের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ছেন; “হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে আল্লাহর চেয়ে আর কে বেশি সত্যবাদী”-(৪:৮৭)?

উত্তরঃ কেউ না।

(সজল রোশনের ভিডিও অবলম্বনে)

 

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url