জিয়াউর রহমান কি বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের আদলে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন?
জিয়াউর রহমান কি বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের আদলে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন?
উত্তর:
"জানিনা আমার কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে। তবে আমি বুকে হাতদিয়ে বলতে পারি,একটিও অসত্য কথা বলবো না।
পাঁচ বছর বয়সেই মেজর জিয়াকে একেবারে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আর তাঁর সাথে করমর্দনের সৌভাগ্য হয় তারও এক বছর আগে। তখন তিনি আমাদের এলাকা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডে এসেছিলেন। কেন এসেছিলেন তা বলতে না পারলেও তখন তার আগমনে এলাকায় প্রচুর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিলো। অনেকটা পথ দৌড়ে ও হেঁটে সেখানে গিয়েছিলাম এবং সৌভাগ্যক্রমে এক চাচার কোলে থেকে হাত ছুঁতে পেরেছিলাম তাঁর যাকে আমি করমর্দন বলেছি।
একই সৌভাগ্য আমার হয়েছে হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ জয়াগ সফরে এলে। সে সময়ও সৌভাগ্যক্রমে তাঁর হাত ছুৃঁতে পেরেছিলাম।
সে যাক। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ছিলাম বাবার চাকুরীর কারণে। সে সময় মেজর জিয়া, খালেদা জিয়া,তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকোকে একেবারে কাছে থেকে দেখেছি। শুধু তাই নয়, সে সময় ক্যান্টনম্যান্টের কার্যাবলী কিছুটা হলেও পরখ করেছি সরাসরি। তবে শুণেছি আমার সরকারি চাকুরে বাবার কাছে।
আজকের লেখায় সে সকল ঘটনার একটি এখানে তুলে ধরবো এবং মেজর জিয়ার শাসনামল সম্পর্কে ধারণা দেব।
খাবার খেতে বসেছি। প্রতিদিন রাতেই আমরা পরিবারের সবাই একত্রে খেতে বসি। কারণ সাধারণতঃ চাকুরীর কারণে বাবা দিনের বেলা আমাদের সাথে খেতে পারেন না।
খেতে বসে খেয়াল করলাম, বাবা খাবার সামনে নিয়ে বসে আছেন,খাবার নাড়াছাড়া করছেন কিন্তু খাচ্ছেন না। মাও বিষয়টা খেয়াল করে বললেন, 'কি হলো? খাচ্ছেন না কেন?' বাবার চোখ মুখ কালো হয়ে গেলো।
আমার বাবার মত শক্ত মনের একজন মানুষেরও মুখ ফ্যাকাশে হলো। চোখের কোণে পানি জমলো। মা সেটা খেয়াল করে বললেন, 'কি হয়েছে?' বাবা ভাঙ্গা গলায় বললেন,"খাবার গলা দিয়ে নামছে না।একটু আগে এ্যাম্বুলেন্সে করে ক্যান্টনম্যান্ট থেকে বেশ কিছু লাশ নদীতে ফেলে আসলাম।এমনটা প্রায়ই হয়। তবে আজকে যখন লাশগুলো ফেলে আসছিলাম, তখন একটা লাশের হাতের সাথে পা আটকে গেলো যেন। পেছন ফিরে তাকাতেই মনে হলো যেন জলজ্যান্ত একটা যুবক ছেলে শুয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর সুন্দর চোখ থেকে যেন আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। ওর ঠোঁট যেন নড়ে উঠলো মুহুর্তে। মনে হলে ও যেন আমাকে বলছে, "আমাকে এভাবে ফেলে যাবেন চাচা?" ছেলেটার মুখ যেন কিছুতেই ভুলতে পারছি না।"
মেজর জিয়ার শাসনামালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এমন ঘটনা ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক। কেন এবং কাকে কখন লাশ করে ফেলে দেয়া হয়েছে তা আজও অজানা।
জিয়াউর রহমান কি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের আদলে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন কিনা জানিনা। তবে এটা বলতে পারি মেজর জিয়া নিজের প্রতিদ্বন্ধীতাকে কখনো পছন্দ করতেন না। তিনি সব সময় নাম্বার ওয়ান হতে চাইতেন এবং হয়েছেনও।
১৯৭৫ এর ৭ ই নভেম্বর খালেদ মোশাররফের বন্দী দশা থেকে যে কর্ণেল তাহের তাঁকে মুক্ত করে ভাঙ্গা পায়ে কাঁধে তুলে নেচেছিলেন, সেই কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসির রশিতে ঝুলাতে একটুও ভাবেননি মেজর জিয়া। যে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে একজন অখ্যাত মেজর থেকে নিজের একটা পরিচিতি তৈরী করতে পেরেছিলেন তিনি, সেই শেখ মুজিবকে হত্যার চক্রান্ত জানতে পেরেও নীরব ছিলেন মোজর জিয়া।
শেখ মুজিব হত্যার পর মেজর ডালিম যখন বুক ফুলিয়ে রেডিওতে সে হত্যার ঘোষণা দিচ্ছিলো,তখন রেডিও বাংলাদেশ কার্যালয়ে(বর্তমান বাংলাদেশ বেতার) উপস্থিত ছিলেন মেজর জিয়া। একজন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত খোন্দকার মোশতাক সরকারের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব হাসিমুখেই গ্রহণ করলেন মেজর জিয়া।
এখানেই শেষ নয়। মুজিব হত্যা সহ ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট থেকে নিজের ক্ষমতাসীন হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের সকল হত্যাকান্ডের বৈধতা দিতে, বিচার বন্ধ করতে জারী করা ইনডেমনিট এ্যাক্টকে সাংবিধানিক বৈধতা দিলেন মেজর জিয়া।
কি? বিচিত্র লাগছে না? সত্যি বিচিত্র।তাহলে আরো শুনুন।
বাংলাদেশের জন্ম যে চার নীতির উপর ভিত্তি করে, যাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমনন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৭২ সালের সংবিধানে স্থান দেয়া হয়। যাকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সেই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে গুড়িয়ে দিয়ে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে মূল নীতি হিসেবে সংবিধানে স্থান দেন মেজর জিয়া। বঙ্গবন্ধু হত্যার আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসে নিয়োগ দিয়ে পুরুষ্কৃত করেন মেজর জিয়া। পৃথিবীর আর কোথাও দেখেছেন এমন নজীর?
একটি পরিবারের সতের জন সদস্য (যাদের মধ্যে দু'জন অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধু এবং দুটি অবুঝ শিশুও ছিলো)কে খুন করা খুনিরা রাষ্ট্র কর্তৃক পুরুষ্কৃত হয়েছে, বিচার বন্ধ করে খুনিদের ইনডিমনিটি দেয়া হয়েছে এবং বিচার না করার সাংবিধানিক বৈধতা দেয়া হয়েছে, এমনটা কোন সভ্য দেশে আছে বলে আমার জানা নেই।
কি অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন আমি মিথ্যে বলছি? একটুও না। বিশ্বাস না হলে আপনি ইতিহাস পড়ে জেনে নিতে পারেন। প্রয়োজনে বর্তমান বিএনপি চেয়ারপারসন এবং মেজর জিয়ার সহধর্মিণী খালেদা জিয়ার কাছ থেকেও আমার দেয়া তথ্যে সত্যাসত্য জেনে নিতে পারেন। তাতেও বিশ্বাস না হলে মেজর জিয়ার সুযোগ্য পুত্র তারেক রহমানের কাছ থেকেও জেনে নিতে পারেন। একটি তথ্য ভুল প্রমাণিত হলে আপনার দেয়া যে কোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব। এমনকি যদি ফাঁসিও দিতে চান,তাও।
আরে ভাই,এখনো শেষ হয়নি। আরো তো শুণুন। নিজেকে সেক্টর কমান্ডার ঘোষণা দেয়া মেজর জিয়া তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেন চিহ্নিত ও প্রমাণিত রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে। মেজর জিয়াই দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করেন, স্থগিত করেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৯৭৩। তিনিই আটককৃত সকল যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেন। গোলাম আজমের মত পলাতক স্বাধীনতা বিরোধী, চিহ্নিত ও স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি প্রদান করেন এবং কোনরূপ নাগরিকত্ব ছাড়াই বাংলাদেশে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। মেজর জিয়াই ১৯৭২ এর সংবিধানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি উম্মুক্ত করে দেন।
কি ভাবছেন? আমি এ সব বানিয়ে বানিয়ে বলছি? একটুও না। এসব তথ্যের একটিও মিথ্যা বা অসত্য হওয়ার কোন সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই বলবেন, এত কিছু করার পরও মেজর জিয়া তাহলে এত জনপ্রিয় কেন? এ ভাবনাটা আমারও রে ভাই। তবে আমার মনেহয় যারা তাঁকে পছন্দ করেন তারা কেউই এ সকল ঐতিহাসিক সত্যের সামান্যও জানেনা। কেউ কেউ জানলেও বিশ্বাস করেনা। এরও অবশ্য কারণ আছে। এবার তা বলছি শুণুন।
আমার দেখা ও জানামতে মেজর জিয়ার সততা ছিলো স্বচ্ছ কাঁচের মত। তাঁর চরম শত্রুরাও তাঁর সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। মুগ্ধ করার মত সততা ছিলো তাঁর। আর ছিলো মানুষকে আপন করে নেয়ার দক্ষতা। সাথে সত্য গোপন করার অসাধারণ ক্ষমতা।
আরো আছে ভায়া। মেজর জিয়ার সাদামাটা জীবন যাপনে আপনি তাঁর ভক্ত হতে বাধ্য। আর তাঁর ধর্ম চর্চা যাই করে থাকুন না কেন, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
শেখ মুজিব ইসলাম ধর্মের উন্নয়ন সাধনে ইসলামী ফান্ডেশন গঠন, বায়তুল মোকারমকে জাতীয় মসজিদ করা, বিশ্ব ইজতেমার জন্য তুরাগ নদীর তীরে জায়গা বরাদ্ধ, ওআইসিতে যোগদান, কাকরাইলে তাবলীগ জামাতের মারকাজ গঠন সহ নানাবিধ কাজ করার পরও মুসলমানদের প্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি,- যেমনটা পেরেছিলেন মেজর জিয়া সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস নীতি হিসেবে গ্রহণ করে এবং সংবিধানে বিসমিল্লাহ লিখে।
এমনটা আরো একজন করেছিলেন তিনি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ।এই লোকটি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম ঘোষণা দিয়ে মুসলমানদের কাছে হিরো হতে পেরেছিলেন। যদিও তাঁর এ কাজটি বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
সঠিক নেতৃত্ব না পেলে বাংলাদেশের অবস্থা আফগানিস্তানের মত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ওওওও - মূল কথাটাইতো বলা হয় নি। বাংলাদেশের মানুষের মনে ১৯৪৭ সালের আগে থেকেই গড়ে উঠা ভারত বিরোধী মনোভাব উস্কে দেয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের মতই দক্ষ ছিলেন মেজর জিয়া। এই ভারত বিরোধীতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেই তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উদবুদ্ধ হয়ে সৃষ্টি হয়েছিলো বাঙ্গালীর দেশ বাংলাদেশ, সেই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাকে হত্যা করতে তিনি ব্যবহার করেছেন ভারত বিরোধী অস্ত্র। আর এ জায়গায় তাঁর অবস্থানটা ছিলো অনেকটা মীরজাফরের মত।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগীতাকে তিনি স্বার্থের হিসেবে দেখিয়েছেন। এমনকি ভারতের সব অবদানকে অবজ্ঞা করে উল্টো ভারতের বিরুদ্ধেই লুটপাটের অভিযোগ করেছেন এবং তা প্রতিষ্ঠিতও করেছেন। অবশ্য এটা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্যও বলা যায়।
৭ ই নভেম্বর ১৯৭৫ এ বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে যে মানুষটি তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন নিজের প্রতিবন্ধী অবস্থাকে ভুলে, সে মানুষটাকেই বিচারের নামে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ফাঁসিতে ঝুলাতেও দ্বিধা করেন নি মেজর জিয়া। এমনকি সেদিন কর্ণেল তাহেরকে তাঁর অপরাধ জানানোর বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগটাও দেন নি মেজর জিয়া।"
(QUORA থেকে সংকলিত)