২৫ শে মার্চ কালরাত্রি - ১৯৭১
রাজারবাগ, ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাসার সদর দরজার উল্টোদিকেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনের মেইন গেট। একেবারে মুখোমুখি। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ কাল রাত্রিতে এখানেই প্রথম পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ শুরু করে, 'অপারেশন সার্চ লাইট'। বাঙালি পুলিশ বাহিনী প্রথম অস্ত্র হাতে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, এই রাজারবাগেই।
সেদিন বিকেল থেকেই শহর থমথম করছিল। নানারকম গুজব ভাসছিল বাতাসে। ৭মার্চের ভাষণ থেকে সবাই বুঝে নিয়েছিল দেশে কিছু একটা হতে যাচ্ছে।
বাসার সব জানালার কাঁচ কালো কাগজ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। গাড়িতে কালো ফ্ল্যাগ উড়িয়েছিলেন পহেলা মার্চ থেকেই। বাড়ির দরজায় কালো রঙ দিয়ে তুলিতে একেঁছিলেন অ আ ক খ শব্দগুলো।
সেদিন বাইরে থেকে বাসায় ফিরেছিলেন খুব অস্থিরতার মাঝে। ঢাকা শহরের ভেতরটা যেনো দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, সাথে তাঁরও ভেতরটা।
সন্ধ্যার আগ থেকেই রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকে বেশ শোরগোল শোনা যাচ্ছিল। আলতাফ মাহমুদ তাঁর শ্যালককে সেখানে পাঠিয়েছিলেন, খোঁজ নিতে। সে এসে জানায় আজ যখন তখন পাকিস্তানী মিলিটারি আক্রমণ করতে পারে তাই পুলিশ ফাড়িতে চলছে প্রতিরোধের আয়োজন।
আউটার সার্কুলার রোডের একদিকে পর পর সাধারণ মানুষের বাড়ি, উল্টোদিকে পুলিশ ফাড়ির সাত-আটশো ফুট লম্বা টিনের ছাউনি দেওয়া শেডস। সেখানেই রান্নাঘর আর পুলিশের বাসস্থান বা কোয়ার্টার। তারপরই শুরু সারি সারি দালান। এই হচ্ছে রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক।
প্রায় শ দেড়েক পুলিশ সন্ধ্যার মধ্যেই দালানগুলোর উপর নিজেদের অবস্থান নেন। বাকিরা রাস্তায়, নালার ধারে বা গাছের আড়াল বেছে পজিশন নেন। ঐ টিনের শেডগুলোতেও কিছু পুলিশ অবস্থান নিয়েছিল। তাছাড়া উল্টোদিকে আলতাফ মাহমুদের মতন সাধারণ নাগরিকদের বাড়ির ছাদেও সশস্ত্র পুলিশবাহিনী অবস্থান নিয়েছিলেন।
২৫শে মার্চ কালরাত্রি, রাত এগারটায় তেজগাঁ থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। ক্রমশ: রাজারবাগের দিকে আসতে থাকে ওরা। আলতাফ মাহমুদ ঘরের সব আলো নিভিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একতলায় চলে যান। এর ঘন্টাখানেক পরে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়। দরজা জানালা বন্ধ, তারপরও গোলাগুলির শব্দে দেয়াল, মেঝে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। পাকিস্তান মিলিটারি ঠিক ওই বাড়ির সদর দরজার সামনে মর্টার বসিয়ে পুলিশক্যাম্পে শেল ছুড়ছিল।
ওদিক থেকেও পাল্টা আক্রণ আসছিল। বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল চারিদিকে দিনের আলো। মিলিটারি সার্চলাইট জ্বেলেছে, ট্রেসার লাইট। সেই আলোয় মিলিটারিরা পুলিশ ব্যারাকের দালানগুলোর উপর সশস্ত্র পুলিশদের অবস্থান দেখে দেখে এগুতে থাকে। ট্রেসার লাইটের সাথে আরো স্পষ্ট দেখার জন্য পাকিস্তানী বাহিনী ব্যারাকের বিশাল টিন শেডে রাত তিনটে নাগাদ আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই আগুনে অনেকে ভেতরই আটক পরে। আগুনের লেলিহান শিখা সহ্য করতে না পেরে ভেতরে থাকা পুলিশরা ব্যারাক ছেড়ে রাস্তার পাশে, নালার ধারে বা সাধারন মানুষের বাড়ির দেয়াল ঘেষে বা কোনো গেটের আড়াল নিয়ে যুদ্ধ করতে থাকে।
আর সে রাতে প্রচন্ড বাতাসে ঠিক রুদ্র নদীর ঢেউয়ের মতো আগুন এদিক সেদিক ধাওয়া করছিল। আগুনের গোলা, বাঁশের টুকরো, টিনের অংশ ছিটকে আশপাশের সবার ঘরে, বারান্দায় আসছিল।
চোখের সামনে গেটের ধারে বাউন্ডারির ভেতর আলতাফ মাহমুদের বড্ড আদরের কাঁঠালগাছটা পুড়ে গিয়েছিল নিমেষেই। তার মাত্র কয়েক হাত দূরেই বাড়ির দেয়াল।
পয়লা মার্চ থেকে দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল।
আলতাফ মাহমুদ বাথরুমে প্রায় চল্লিশ গ্যালন পেট্রল মজুত করেছিলেন। যুদ্ধ হলে মলোটভ বোমা তৈরী করবার জন্য। তিনি বুঝেছিলেন আজ হোক কাল হোক শত্রু পক্ষের মিলিটারির সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য। তাই ঐ পেট্রলের এক কণাও গাড়ির জন্য খরচ করেন নাই। আগুনের তাপে পুরো বাড়িটা তেঁতে উঠছিল। চারিদিকে পোড়া গন্ধ। আগুনের আঁচ সইতে না পেরে টিনশেডের ঠিক উল্টো দিকের বাড়িগুলো থেকে বৌ-বাচ্চা নিয়ে মানুষ জন গলির মধ্যেই দৌড়ে বেড়িয়ে পরে। পরিবারের সবাইকে আলতাফ মাহমুদ বারবার বলেছিলেন, ভয় পেয়ো না, আমি আছি।
পেছনে প্রতিবেশীর বাড়িতে সবাইকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি এসে শীতের ভারী কাপড়, কম্বল, তোয়ালে ভিজিয়ে পেট্রলের টিনের ওপর চাপা দিয়ে নিজে তিনি সারারাত বাথরুমে থেকেছেন।বাথরুমে একটু-আধটু আগুন যা আসছিল তা সাথে সাথে নিভিয়ে ফেলছিলেন। রাতের কয়েক ঘন্টা সেই ভয়ঙ্কর বিপদের সঙ্গে উনি একলা যুদ্ধ করেছিলেন।
ঠিক গেটের সামনে পিশাচ মিলিটারিরা পজিশন নিয়ে আছে। চতুর্দিকে অবিরাম গুলির শব্দ। মানুষজনের আর্তনাদ। পাকিস্তানী সৈন্যদের উল্লাসধ্বনি। দিন না রাত বোঝা যায় না। লকলকে আগুনের শিখা বাতাসে সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
বাথরুমে কয়েকঘন্টা ধরে একা, একেবারে একা, পাহারা দিতে দিতে সুরের বরপুত্র আলতাফ মাহমুদ দেখছিলেন পাক সেনাবাহিনী বাংলাদেশে আগুন জ্বেলেছে। আগুনে সংসার পুড়ছে, মানুষ পুড়ছে, গাছ পুড়ছে। পোড়া গন্ধে নিশ্বাস নেওয়া দায়। আগুনের আঁচে বাথরুমেও টেকা যায় না। কিন্তু চল্লিশ গ্যালন পেট্রল না বাঁচলে উঠোনের ঘাসগুলো পুড়ে কালো হয়ে যাবে, আশেপাশের অনেকগুলো বাড়ির মাথায় নেমে আসবে সর্বনাশা আগুনের শিখা। আর অপচয় হবে এক অমূল্য সম্পদের, প্রতিরোধ সংগ্রামে যা বড্ড প্রয়োজন, মলোটভ বোমা তৈরীর জন্য রাখা পেট্রল।
এক সময় বাতাসের গতি কমে যাওয়ায় সেদিন সবাই বেঁচে গিয়েছিল। নাহলে আশপাশ বাড়িগুলো রাতেই পুড়ে ছাই হয়ে যেতো। পোড়া আগুনের মধ্য দিয়ে কখন ভোরের আলো ফুটে উঠেছিল তা টের পাওয়া হয়নি কারো।
২৬মার্চের ভোরবেলা যেই পুলিশ সদস্যরা আলতাফ মাহমুদের বাড়ির ছাদ এবং আশপাশে থেকে যুদ্ধ করেছিলেন, তারা ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে আসেন। আলতাফ মাহমুদের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে এবং তাঁদের পোশাক ফেলে সাধারণ পোশাক গায়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যান। ২৮, ২৯, ৩০ মার্চ রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে পুলিশ সদস্যের কেউ কেউ নিজেদের অস্ত্র ফেরৎ নিয়ে যান। কিন্তু অনেকে আর আসেনি, হয়তো আর কোনদিনও আসতেন না।
২৬মার্চ সকাল শুরু না হতেই পাকিস্তানী মিলিটারিরা জিপে টহল দিতে দিতে মাইকে ঘোষণা করতে থাকে, পুলিসলোক আর্মস থাকলে সারেন্ডার করো। ঘোষনা শোনামাত্র আলতাফ মাহমুদ পুলিশদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র পেছন দিকের গলিতে এক গভীর নালার জলে ডুবিয়ে আসেন। তাঁদের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত পোশাকের কিছু মাটির নিচে পুঁতে রাখেন আর বাকীটা আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন।
২৭ মার্চ ঢাকায় চার ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল হয়। আলতাফ মাহমুদ তখন তাঁর পরিবারে সবাইকে কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দিরে নিয়ে যান। দুদিন পর শোনা যাচ্ছিল, মন্দিরও আক্রমণ করা হবে। তখন খিলগাঁও-এ এক আত্মীয়ের বাসায় পরিবারকে রেখে আসেন। আলতাফ মাহমুদ বাড়ি লুট হবে এই অযুহাতে রাজারবাগের বাসায় একা থাকতেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি একদিনের জন্যও ৩৭০, আউটার সার্কুলার রোডের বাড়ি ছেড়ে আর অন্য কোথাও আশ্রয় নেননি।
পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দূর্গবাড়ি গড়ে তুলেছিলেন সেখানেই। যুদ্ধের প্রথম থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য গান তৈরী করে মেলাঘর পাঠাতেন। এবং একসময় ঢাকার গেরিলা বাহিনী ক্র্যাক প্লাটুনের সাথে সরাসরি জড়িত হয়ে যান। ঢাকায় অবস্থিত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ, আশ্রয়, গেরিলা মিটিং এবং মেলাঘরের সাথে তথ্য আদানপ্রদান সেই বাড়িতেই সংগঠিত হতো। তাঁর দূর্গবাড়ি ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে নির্ভরশীল জায়গা।
একাত্তরের ৩০অগাস্ট আলতাফ মাহমুদের বাড়ি থেকে দুই ট্রাংক অস্ত্র এবং অন্যান্য ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যের সাথে তাঁকেও ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। তিনি সহ আরো ছয়জন ক্র্যাক গেরিলাকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। নির্মম এবং পৈশাচিক অত্যাচারে তাঁদের হত্যা করা হয়।
এই সাত বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুদিন নেই, কবরও নেই।
আলতাফ মাহমুদ তাঁর যাপিত জীবনে দেশের মানুষের জন্য লড়াই করে গেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তর তিনি কখনও থেমে থাকনেনি। রাজপথ, জনপথ, মিছিল, প্রভাতফেরী, প্রতিবাদী অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদের শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল সর্বত্র। ভাষা আন্দোলনের জন্য এক ঐশ্বরিক সুরে একুশের গান দিয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযু্দ্ধে সরাসরি জড়িত হয়ে স্বাধীন ভূমি পাওয়ার লক্ষ্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
বাংলাদেশে চিরদিনের জন্য এক অদম্য শক্তি আর সাহসের নাম, আলতাফ মাহমুদ।
লেখক: শহীদ আলতাফ মাহমুদ এর মেয়ে শাওন মাহমুদ